কুমিল্লা তিতাসের বাসিন্দা রহিমা বেগম (৬২)। এক সপ্তাহ আগে থেকে করোনা উপসর্গে ভুগছিলেন। তার সন্তানরা প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি স্থানীয় একটি সরকারি হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা করান। ফলাফল আসার আগেই তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। দুদিন পর যখন ফলাফল আসে তখন তার শারীরিক অবস্থার ব্যাপক অবনতি হয়। রহিমাকে নেয়া হয় কুমিল্লা সদরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকরা সিটিস্ক্যান ও এক্সরে করে জানতে পারেন রহিমার ফুসফুস প্রায় ৬০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই তাকে তাড়াতাড়ি ঢাকায় পাঠান এবং পরামর্শ দেন আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেয়ার জন্য। চিকিৎসকের পরামর্শে সোমবার দুপুরে রহিমার দুই ছেলে তাকে নিয়ে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে আইসিইউ শয্যা না পেয়ে যান মুগদা হাসপাতালে। সেখান থেকে তাদের পাঠানো হয় ডিএনসিসি কোভিড জেনারেল হাসপাতালে। সেখানেও আইসিইউ না পেয়ে তারা যান কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। তারপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে শেষ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন রহিমার সন্তানরা। সামর্থ্য অভাবে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ শয্যায় রেখে চিকিৎসা করাতে না পেরে অবশেষে বাড়ি নেয়া হয় রহিমাকে। করোনার তৃতীয় ধাক্কায় বিপর্যস্ত পুরো দেশ। প্রতিদিনই মৃত্যু ও শনাক্তের নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। আক্রান্তদের শারীরিক অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। বিশেষ করে আক্রান্তদের বেশিরভাগের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে এবং ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জটিল রোগীদের আইসিইউ শয্যায় রেখে চিকিৎসার কোনো বিকল্প নেই। অথচ দেশে যে পরিমাণ আইসিইউ শয্যা রয়েছে সেগুলো দিয়ে জটিল রোগীদের চাহিদা কিছুতেই মেটানো যাচ্ছে না। রহিমা বেগমের মতো অনেক রোগীকে নিয়ে স্বজনরা হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরছেন। কোথাও আইসিইউ মিলছে না। সরকারি করোনা হাসপাতালের আইসিইউ একটি শয্যা খালি হলে বিপরীতে অন্তত দুইশ’ রোগীর সিরিয়াল থাকছে। কর্তৃপক্ষ জটিল রোগী বিবেচনায় সেই শয্যা বরাদ্দ দিচ্ছেন। আবার অনেক সময় বড় তদবিরে খালি শয্যায় রোগী ভর্তি নেয়া হচ্ছে। শুধু আইসিইউ শয্যা যে অপ্রতুল তা নয়, আইসিইউ সমতুল্য শয্যা হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা বা এইচডিইউ শয্যা বা এইচডিইউ সমতুল্য শয্যা অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটরের সংখ্যাও অপ্রতুল। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ৩৯৩টি আইসিইউ, ৫০৮টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও ২০২টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর রয়েছে।স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে তাতে শুধু আইসিইউ বা আইসিইউ সমতুল্য শয্যা বাড়িয়ে কাজ হবে না। বরং সংক্রমণ যাতে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ চাইলেই আইসিইউ শয্যা বাড়ানো যাবে না। বাড়াতে যন্ত্রপাতিসহ পরিচালনার জন্য দক্ষ চিকিৎসক ও নার্সের প্রয়োজন আছে। দেশে এখন আইসিইউ পরিচালনার দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। এছাড়া সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে তড়িঘড়ি করে আইসিইউ স্থাপন করে বিশেষ সুফল পাওয়া যাবে না। তাই এই মুহূর্তে বিকল্প চিন্তা করতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে নমুনা পরীক্ষা বাড়ানোসহ, উপজেলা হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ, রোগীদের শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া আইসিইউ শয্যা সময়সাপেক্ষ হওয়াতে আপাতত হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার সংখ্যা বাড়িয়ে রোগীদের সেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে ১৬টি সরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। তিনটি হাসপাতালে সাধারণ শয্যা থাকলেও আইসিইউ, হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা বা আইসিইউ সমতুল্য শয্যা এবং অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটরসহ এইচডিইউ সমতুল্য শয্যা নেই। বাকি ১৩টি হাসপাতালে ৩৯৩টি আইসিইউ, ৫০৮টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও ২০২টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটরসহ এইচডিইউ সমতুল্য শয্যা রয়েছে। এরমধ্যে কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে ২৬টি আইসিইউ, ৪১টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও ৫টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর রয়েছে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ শয্যা, ৫৭টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ৩০টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ১৬টি আইসিইউ, ৩০টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ৩১টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর। সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে ৬টি আইসিইউ, ১৬টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ৪টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০টি আইসিইউ, ৯৫টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ৬টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৪টি আইসিইউ, ৩০টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ৫টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ, ৩০টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ১৫টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১৫টি আইসিইউ, ২৬টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ২৮টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ৮টি আইসিইউ, ১৭টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ৩টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিভি হাসপাতালে ১৬টি আইসিইউ, ৩০টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ, ৬টি হাই-ফ্লো ন্যাজালা ক্যানুলা, ২০টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ২০টি আইসিইউ, ৫০টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ২৫টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর ও ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ২১২টি আইসিইউ, ৮০টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও ৩০টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিদিনের করোনা আপডেটে আইসিইউ শয্যার তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। তারা ঢাকার সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার যে পরিসংখ্যান দিচ্ছেন তার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২৬শে জুলাই সোমবারের দেয়া তথ্য জানানো হয়েছে ঢাকার ১৩টি সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৩৯৩টি। আর খালি আছে ৪৮টি। এরমধ্যে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬টি শয্যার ১টি, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫টি শয্যার ৫টি, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিভি হাসপাতালের ১৬টি শয্যার ১২টি, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ১০টি শয্যার ৫টি এবং ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের ২১২টি শয্যার ২৩টি আইসিইউ শয্যা খালি আছে। বাস্তবে একটি শয্যাও খালি ছিল না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া এসব তথ্য দেখে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে রোগী নিয়ে আইসিইউর সন্ধানে যান অনেকেই। কিন্তু কেউই আইসিইউ শয্যা পাননি। নরসিংদীর স্টেশন এলাকার বাসিন্দা আরাফাত হোসেন করোনা আক্রান্ত হয়ে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অক্সিজেন লেভেল বিপদসীমায় নেমে আসাতে মুগদার চিকিৎসকরা তাকে আইসিইউতে নেয়ার পরামর্শ দেন। মুগদায় আইসিইউ শয্যা খালি না থাকায় আরাফাতের স্বজনরা বিভিন্ন হাসপাতালে আইসিইউ সন্ধান করেন। কিন্তু শয্যা পাননি। পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিদিনের করোনা আপডেট থেকে আরাফাতের ছেলে মাহিন জানতে পারেন কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি আছে। সে অনুযায়ী মাহিন ওই হাসপাতালগুলোতে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হন। মাহিন বলেন, প্রতিদিনই অধিদপ্তর বলছে বিভিন্ন হাসপাতালে আইসিইউ, সাধারণ শয্যা খালি আছে। কিন্তু খোঁজ নিতে গেলে ওই হাসপাতালগুলো বলে খালি নেই। তাদের এই তথ্যগুলো শুধু আমি না অনেক রোগীর স্বজনকে হয়রানিতে ফেলছে। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, তারা প্রতিদিনের আপডেট অধিদপ্তরকে দিচ্ছেন। কিন্তু অধিদপ্তর প্রতিদিন যে প্রেস রিলিজ দিচ্ছে তার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, বেশিরভাগ আইসিইউ রোগী গ্রাম থেকে শহরে আসছেন। তার মানে গ্রাম অঞ্চলে করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরে যারা অবহেলা করে প্রাথমিক চিকিৎসা নিচ্ছেন বা চিকিৎসা পাচ্ছেন না তারা যখন ঢাকায় আসেন তখন খুব জটিল অবস্থায় আসেন। এ কারণে তাদের আইসিইউ দরকার হচ্ছে। শনাক্তের সংখ্যা যত বাড়বে ততই জটিল রোগীর সংখ্যা বাড়বে। এজন্য আইসিইউও লাগবে। তাই আইসিইউ বাড়িয়ে এটার সমস্যার সমাধান করা যাবে না। যে হারে রোগী বাড়ছে সেই হারে আইসিইউ শয্যা বাড়ানো সম্ভব না। তাই রোগী যাতে না বাড়ে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এটি করতে পারলে রোগীর সংখ্যা কমবে। আর রোগীর সংখ্যা কমলে আইসিইউ চাহিদা কমে যাবে। এছাড়া এই মুহূর্তে নতুন কিছু করার সুযোগ নেই। তবে কিছু জায়গায় ফিল্ড হাসপাতাল করে কিছু আইসিইউ সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। তিনি বলেন, আইসিইউ মানে হচ্ছে, দুটি অংশ। একটি হলো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যেমন, আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেনসহ অন্যান্য। আরেকটি হলো- দক্ষ জনশক্তি যেমন-আইসিইউ চিকিৎসক, নার্স। যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন উপকরণ চাইলে দ্রুত কেনা যায়। কিন্তু গত দেড় বছরে আইসিইউ পরিচালনায় চিকিৎসক, নার্স তৈরির জন্য দ্রুত গতিতে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে আইসিইউ বেড বাড়ানো যাবে যেকোনো সময়। তবে চিকিৎসক ও নার্স চাইলেই বাড়ানো যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও করোনা পূর্বাভাস বিষয়ক গবেষক দলের প্রধান শাফিউন নাহিন শিমুল মানবজমিনকে বলেন, উপজেলা হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সাপ্লাই বাড়াতে হবে। যারা ঢাকায় বা উপজেলা হাসপাতালে যাচ্ছে তাদের অক্সিজেন লেভেল অনেক কম থাকে। তারা বুঝে উঠতে পারছে না তাদের অক্সিজেন লেভেল বিপদসীমায় নেমে আসছে। যারা একটু তাড়াতাড়ি হাসপাতাল পর্যন্ত আসতে পারে তাদের অবস্থা ততটা খারাপ হয় না। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে আইসিইউ এখনই দেয়া যাবে না। কারণ আইসিইউ দিতে হলে যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে দক্ষ জনবলের প্রয়োজন আছে। তিনি বলেন, আইসিইউ স্থাপন করা এতো সহজ না। এটি বললেই সম্ভব না। আর আইসিইউ স্থাপন করার মতো সময়ও হাতে নেই। তাই উপজেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে হবে। হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে উপজেলা পর্যায়ে এটি দেয়া যেতে পারে। এছাড়া যে পরিমাণ আইসিইউ শয্যা আছে সেগুলো কার্যকর করতে হবে। কারণ সরকারি হিসাবে যতগুলো আইসিইউ শয্যা আছে সেগুলোর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কাজ করছে। সর্বোপরি আইসিইউ পর্যন্ত যাতে রোগীদের যেতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।