আগের দিন রানা প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলায় ফাটলের কথা শুনেছিলেন রুপালি আক্তার। খুব একটা পাত্তা দেননি। মনে মনে ভাবছিলেন, ফাটলের কারণে কারখানা বন্ধ থাকবে? তাই পরদিন সাড়ে সাতটার দিকে নতুন জামা পরে মজিদপুরের বাসা থেকে কারখানায় গেলেন রুপালি। পরিকল্পনা ছিল, কারখানা বন্ধ থাকলে কয়েকজন মিলে নবীনগরে ঘুরতে যাবেন।
২৪ এপ্রিল ঝুঁকির মধ্যেও কারখানা খোলা। সপ্তম তলার নিউওয়েব বটমস লিমিটেডের হেলপার রুপালি আক্তার কাজ শুরু করেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। ভবনধসে অন্য অনেক সহকর্মীদের সঙ্গে চাপা পড়েন রুপালিও। ১৮ ঘণ্টা পর উদ্ধারকর্মীরা ছাদ কেটে অন্যদের সঙ্গে তাঁকেও উদ্ধার করেন। এই দীর্ঘ সময় রুপালি আক্তার তাঁরই সহকর্মী তানজীলার মৃতদেহের ওপর শুয়েছিলেন। রুপালির ওপর ছিলেন জীবিত আরেকজন।
কেমন আছেন রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে দু’পা হারানো রেবেকা
গার্মেন্টস খাতে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা রানা প্লাজা ধসের স্মৃতিও সময়ের সাথে সাথে বিলীন হতে চলেছে। কিন্তু এখনো থামেনি শোকের মাতম। স্বজন হারানো স্মৃতি। ঘটনার শিকার পরিবারগুলো এখনো আছে আতঙ্কে।
২৪ এপ্রিল, শনিবার রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এই দিনটির ৮ বছর পূর্ণ হয়েছে। গত ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলের এই দিনে সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার বারাই হাট এলাকার গার্মেন্ট শ্রমিক রেবেকা খাতুন দুই পা হারায়। দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার বারাইহাট এলাকার চেয়ারম্যান পাড়া গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা মেলে, দুই পা হারানো রেবেকা খাতুনের। বাড়িতে তিনি এবং তার দুই বছরের ছেলে মাদানী আন্নুর শুয়ে আছে, ছয় বছরের মেয়ে সিজরাতুন মুনতাহাকে পাশে নিয়ে বসে আছে।
রেবেকা রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় পুরোপুরি সুস্থ হতে প্রায় ১০ মাসের মতো তাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। দুই পায়ে মোট আটবার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। ওই দূর্ঘটনায় তিনি তার মাসহ পরিবারের আরো দু’জনকে হারিয়েছেন।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি: এখনো আতঙ্ক কাটেনি আহত দম্পতির
জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু বেদনাবিধুর স্মৃতি, যা কখনই মুছে ফেলা যায় না। আট বছর আগের এইদিনে সাভারের রানা প্লাজা হয়ে উঠেছিলো দুঃখ-বেদনার এক শোকগাঁথা। এ প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রাণে উদ্ধার হয়েছিলেন গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর জিয়াউর রহমান ও মনিফা বেগম নামের এই দম্পতি। সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার আতঙ্ক এখনো কাটেনি এ দম্পতির।
সরেজমিনে শনিবার (২৪ এপ্রিল) উপজেলার দামোদপুর ইউনিয়নের দামোদরপুর (বুড়িরভিটা) গ্রামের বাসিন্দা ও রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আহত দম্পতি জিয়াউর ও মনিফা জানালেন সেই ট্র্যাজেডির এক বেদনা বিজড়িত ঘটনা।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল পৌনে নয়টার দিকে রানা প্লাজাটি ধসে পড়ার ঘটনা ঘটে। সেইদিনর এ ঘটনায় কেউ হারিয়েছেন তার মাকে, কেউ তার বাবা, কেউ তার ভাই, কেউ বোন, কেউ তার স্ত্রী, কেউ আবার স্বামীকে। আর ইট-কংক্রিটের ধ্বংস্তুপের চিপায় আটকা পড়ছিলেন হাজার হাজার শ্রমিক। তাদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী মনিফা বেগমও আটকা পড়ছিলেন।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি: নিখোঁজ মেয়েকে আজও খোঁজে মা
আট বছর আগে ২৪ এপ্রিল ঢাকা সভারের রানা প্লাজা নামের বহুতল ভবন ধসে পড়েছিল। এ ঘটনায় নিখোঁজ হয়েছেন গাইবান্ধার দামোদরপুর এলাকার কামনা বেগম (২৫)। নিখোঁজের ৮ বছরেও তাকে খুঁজে পাইনি স্বজনরা। আজও এই মেয়ের সন্ধানে নির্ঘুম রাত কাটে মা মফিজানের।
শনিবার (২৪ এপ্রিল) গাইবান্ধার কান্তনগরের কিশামত দশলিয়া গ্রামে দেখা যায় নিখোঁজ কামনার মা মফিজানের আর্তনাদ। এসময় মেয়ের ছবি বুকে নিয়ে অঝড়ে কাঁদলিনে তিনি।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি: মা হারা সন্তানের ঠাঁই এখন দাদীর কোলে
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে ধসে পড়েছিল রানা প্লাজা ভবন। এসময় ইট-কংক্রিটে চাপা পড়ে হারিয়ে যায় সহস্রাধিক তাজা প্রাণ। এসব প্রাণের মধ্যে গাইবান্ধার লিপি বেগমেরও মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। এই লিপি বেগমের রেখে যাওয়া একমাত্র মেয়ে জেরিন আক্তারের (১০) এখন ঠাঁই হয়েছে দাদীর কোলে। বৃদ্ধা দাদী জেলেখা বেগমের আদর-যত্নে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে জেরিন।
শনিবার (২৪ এপ্রিল) গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার দামোদরপুর (বুড়িভিটা) গ্রামের বৃদ্ধা জেলেখা বেগমের পাশে বসে থাকতে দেখা যায় মা হারা জেরিন আক্তারকে। এসময় মায়ের মৃত্যুর ঘটনা শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল জেরিন।
‘শ্রমিক হত্যার বিচার হয় না রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি তারই উদাহরণ’
ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মানবসৃষ্ট দুর্যোগ রানা প্লাজা ধসে নিহত শ্রমিকদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলেছেন, আট বছর পার হয়ে গেলেও রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক নিহত হওয়ার কোনো বিচার হয়নি। নির্মম এই ঘটনার অভিযোগপত্র দিতেই পার হয়েছে তিন বছর।
তারা আরও বলেন, ভবন মালিক সোহেল রানা ব্যতীত অভিযোগপত্রের ৪১ জন আসামির আর কেউ কারাগারে নেই। শ্রমিক হত্যার জন্য এদেশে কোনো শাস্তি পেতে হয় না রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া তারই উদাহরণ।
রানা প্লাজা ধসের ৮ বছর পূর্তি, সীমিত পরিসরে আয়োজন
সাভারের রানা প্লাজা ধসের আট বছর পূর্তি উপলক্ষে নিহত শ্রমিকদের স্মরণে করোনার পরিস্থিতিতে এবার সীমিত পরিসরে কর্মসূচির আয়োজন করেছে নিহত শ্রমিকদের পরিবার, আহত শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো।
শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) সন্ধ্যায় মোমবাতি প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এ কর্মসূচি।
শনিবার (২৪ এপ্রিল) সকালে রানা প্লাজার বেদিতে ফুল দেয়ার মাধ্যমে শেষ হবে এ কর্মসূচি।