২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল, দিনটি দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম ভবন ধসের জন্য লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। সেদিন সাভারের ৯ তলা ভবন ‘রানা প্লাজা’ ধসে পড়েছিল। ইট-কংক্রিটের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিকের। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এ শিল্প দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ২ হাজার ৪৩৮ শ্রমিক। আহত অনেকেই পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। অনেকে বাঁচার তাগিদে আজও জীবিকার খোঁজ করে চলেছেন।
রানা প্লাজার তৃতীয় তলার একটি পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন রোকেয়া আক্তার। ভবন ধসের সময় তিনি কাজের মধ্যেই ছিলেন। রোকেয়া জানান, রানা প্লাজা ধসে পড়ার সময় বিকট আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন। এরপর আর কিছু মনে নেই তাঁর। ২৪ দিন পর নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করেন। রানা প্লাজা ধসে তাঁর বুকের হাড় ভেঙেছে, মাথায় ও মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে এখনও সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। বাম হাত দিয়ে কিছুই শক্ত করে ধরতে পারেন না। শারীরিক সমস্যার সঙ্গে মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়। বড় ভবন দেখলেই মনে হয়– এ যেন এখনই ভেঙে পড়বে। এরপর আর কোনো চাকরিতে ঢুকতে পারেননি। তাঁর গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী জেলায়। সেখানে এখন চলছে একমাত্র মেয়ে জান্নাতকে নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা। চিকিৎসা বলতে চলে শুধু কিছু ব্যথানাশক।
রোকেয়ার স্বামীর বাড়ি ছিল ময়মনসিংহে। স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করাতে রোকেয়া জানান, ‘সে তো চলে গেছে হাসপাতাল থেকেই। কিছু টাকা-পয়সা তখন পেয়েছিলাম। তা নিয়ে সে পালিয়ে গেছে। এরপর আর কোনো খোঁজ নেয়নি। হয়তো ভেবেছে, আমি তাঁর জন্য বোঝা হয়ে গেছি।’ রানা প্লাজা ধসের সময় জান্নাত ছিল কোলের শিশু। এখন সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। রোকেয়া আরও জানান, তিনি একটি অফিসে ঝাড়ু দিয়ে দেড় হাজার টাকা পান। তা দিয়েই চলে মা-মেয়ের টিকে থাকার সংগ্রাম।
রানা প্লাজার আরেক শ্রমিক রাশিদা বেগম তখন সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করতেন। ভবন ধসের সময় তিনি সেখানে কাজ করছিলেন। কোমর, মাথা ও পায়ে পেয়েছেন গুরুতর আঘাত। দ্রুত উদ্ধার হওয়ায় সে যাত্রায় বেঁচে যান। তবে গায়ে বয়ে বেড়াতে হয়েছে ক্ষতের বোঝা। দীর্ঘসময় ধরে কাজ করতে পারেন না। মাথা ভারী হয়ে ওঠে। মাথাব্যথার তীব্রতাও প্রতিদিনই যেন বাড়ছে। রাশিদা জানান, রানা প্লাজা ধসের পর তিনি আর কোনো চাকরিতে ঢুকতে পারেননি। চাকরি পেয়েছেন; কিন্তু তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এখন বড় কোনো ভবনে ঢুকতেও ভয় পান। মনে হয়, এই বুঝি ভেঙে পড়ল। সেই ভয়ের আবহ ১০ বছর ধরে তাঁদের তাড়া করে ফিরছে।
‘একশনএইড বাংলাদেশ’-এর এক সমীক্ষা অনুসারে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে বেকারত্বের হার হ্রাস পেলেও বর্তমানে ৫৪.৫ শতাংশ কর্মহীন রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৮৯ শতাংশ গত ৫ থেকে ৮ বছর ধরে কর্মহীন, আর ৫.৫ শতাংশ কর্মহীন রয়েছেন গত ৩ থেকে ৪ বছর ধরে।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১২ এপ্রিল রাজধানীর একটি কনভেনশন হলে আয়োজিত ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনা: ট্র্যাজেডি থেকে ট্রান্সফরমেশন’ শীর্ষক এক বহুপাক্ষিক আলোচনায় এই সমীক্ষায় প্রাপ্ত ফলফল উপস্থাপন করা হয়। একশনএইড বাংলাদেশের পক্ষে ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল বিজনেস (আইএসবি) এই সমীক্ষাটি পরিচালনা করেছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় জীবিত ২০০ জন পোশাক শ্রমিক এবং মৃত পোশাক শ্রমিকদের পরিবারের মধ্যে এই সমীক্ষা চালানো হয়। উত্তরদাতাদের মধ্যে ছিলেন ৬৯.৫ শতাংশ নারী এবং ৩০.৫ শতাংশ পুরুষ। সমীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলে বেঁচে থাকাদের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত শারীরিক স্বাস্থ্যের অবস্থা, মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতা এবং আর্থিক অবস্থাসহ বেশ কয়েকটি মূল বিষয় তুলে ধরা হয়।
সমীক্ষায় পাওয়া তথ্য মতে, শারীরিক স্বাস্থ্য জীবিত অনেক শ্রমিকের জন্য কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটিই তাঁদের বেকারত্বের পেছনে মূল কারণ। তবে এই হার গত বছরে ছিল ৬৭ শতাংশ, যা বর্তমানে কমে ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। সমীক্ষা আরও বলছে, রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়াদের শারীরিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। এ বছর ২২.৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁদের শারীরিক স্বাস্থের অবনতি হয়েছে; যা ২০১৪ সালে ছিল ৯ শতাংশ। উত্তরদাতাদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি (৩৬.৮ শতাংশ) উল্লেখ করেছেন, তাঁরা পিঠের ব্যথায় ভুগছেন; এক-চতুর্থাংশ (২৪.৬ শতাংশ) মাথাব্যথার বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে রয়েছে– শ্বাসকষ্ট, হাত ও পায়ে আঘাত, দাঁড়াতে ও সঠিকভাবে হাঁটতে না পারা, দৃষ্টিশক্তি ও কিডনির সমস্যা ইত্যাদি। মনোসামাজিক স্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ অনুভব করা লোকের হার হ্রাস পেলেও মোটামুটি স্থিতিশীল বলে দাবি করার হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ইতিবাচক প্রবণতা সত্ত্বেও, এখনও ২৯ শতাংশ মানসিক ট্রমার মধ্যে বেঁচে আছেন, যাঁদের অবস্থার দিন দিন অবনতি হচ্ছে। মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত ২৯ শতাংশের মধ্যে ৫৭.৮ শতাংশ উত্তরদাতারা বলেছেন, তাঁদের মধ্যে ভবন ধসে পড়ার ভয় কাজ করে। ২৮.৯ শতাংশ তাদের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।