টিনের বেড়া আর কাঁটাতারের সীমানা দিয়ে ঘেরা চারপাশ। ওপারের ঘেরাটোপের মাঝে বিশাল জায়গা জুড়ে এক শ্মশান, যেখানে বালু-পাথর, কংক্রিটের টুকরোর মাঝে মিশে আছে মানুষের দেহাবশেষ। একটু খোঁড়াখুঁড়ি করলেই হয়তো হঠাৎ ভয় পাইয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়বে কারও দাঁত-কপাটি, কশেরুকা, হাড়, কিংবা খুলি।
শ্মশানের মাটিতে এবড়োথেবড়ো ছোট ছোট ঢিবি, পাশে খানাখন্দ। চারপাশে ছড়িয়ে আছে লাল-নীল-বেগুনি ছিন্নভিন্ন খণ্ড খণ্ড নানা রংয়ের কাপড়ের টুকরো, যেমন খণ্ড খণ্ড হয়েছে মানুষের শরীর। পড়ে আছে সুতা, হাজার হাজার বোতাম, কারও ব্যাগ, রক্তমাখা কাপড়, আর নানা নামের বিদেশি ট্যাগ। ওপর থেকে দেখলে মনে হবে ভীষণ প্রলয়ঙ্করী এক ঝড়ে তছনছ হওয়া এক বিস্তীর্ণ এলাকা। ২৪ এপ্রিল ২০১৩-এর চিহ্ন এসব।
ওইদিনে রানা প্লাজায় লণ্ডভণ্ড হয়েছে মানুষ-মেশিন, লোহা-লক্কড়, বালু-সিমেন্টের সাথে হাজার হাজার স্বপ্ন। সেইদিনের সেই ঝড় আর কিছু নয়, নয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ কিংবা কোনো ষড়যন্ত্রকারী দলের ভবন ধরে টানাটানির ফল; বরং কিছু মানুষ, গোষ্ঠী আর রাষ্ট্রের অমনোযোগ-অবহেলায় তৈরি এই ঝড়। যে ঝড়ের আরেক নাম হত্যাকাণ্ড। কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড।
২৪ এপ্রিল হাজারো চেষ্টায় ভুলবার নয়। ২০১৩ সালের ওইদিনে রাজধানী ঢাকার ফার্মগেট এলাকা থেকে প্রায় ২১ কিলোমিটার দূরে সাভার অঞ্চলে অবস্থিত রানা প্লাজার ভবনধসে মারা পড়ে প্রায় নিহত নিখোঁজসহ ১১৭৫ জনেরও (সূত্র : বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির গবেষণা) বেশি শ্রমিক। যার মধ্যে এখনো নিখোঁজ আছে ১৬২ জনের ওপর। ওইদিন খুব ভোরে দল বেঁধে এসেছিল ওরা। একে একে উঠেছিল নিউ ওয়েভ বটম লি:, ফ্যান্টম অ্যাপারেল, ফ্যান্টম টেক, ইথারটেক্স এবং নিউওয়েভ স্টাইলের মোট পাঁচটি কারখানায়।
তিন তলা থেকে আট তলা পর্যন্ত এক একটি কারখানা। নয় তলা ভবনের নিচের দুই তলায় দোকানপাট, ব্যাংক, মার্কেট আর ওপরের তলা ফাঁকা, মাঝখানে পাঁচ-পাঁচটি কারখানা। ‘দানব’ জেনারেটরগুলো নিচতলার বদলে ছিল তিন তলা আর আট তলায়। বিল্ডিংয়ের বাইরের অংশের নীলাভ কাঁচের দেয়াল দেখে ভেতরের নড়বড়ে অবস্থা বোঝার উপায় নেই কারও।
রবীন্দ্রনাথ সরকারসহ আরও কার কার জমি অবৈধভাবে দখল করে ওখানে গড়ে উঠেছিল ‘রানা প্লাজা’ ভবন! সোহেল রানার পরিবারের আবার পরের জমি দখলের সুখ্যাতি আছে। স্থানীয়রা প্রথম প্রথম ভয়ে মুখ খুলতো না, বলতো, ‘তাকে (সোহেল রানা) নিয়ে কিছু বললে তো মহা বিপদ, তার ওপর স্থানীয় এমপি মুরাদ জং-এর সুনজর আছে। পরে এসব বলার জন্য কী বিপদ আসে আমাদের, কে জানে!’
যাক যে কথা বলছিলাম, আগের দিন নানা খবর শুনে কারখানা পর্যন্ত পৌঁছে নানা আতঙ্ক কাজ করছিল শ্রমিকদের। কিন্তু প্রশাসনের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত কাজে ঢুকলো সবাই। শ্রমিকদের জীবনের চেয়ে মালিকের কাছে শিপমেন্ট অনেক জরুরি, নিরুপায় শ্রমিক না জেনে না বুঝে কাজে হাত দেয়।