মানবপাচার ও মুদ্রাপাচারে অভিযোগে কুয়েতে আটক লক্ষ্মীপুর-২ আসনের বিতর্কিত সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল এবার দেশটির গোয়েন্দাদের চাপে পড়ে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন। আর একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে ।কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মানব পাচার ও মুদ্রা পাচার, ঘুষ-দুর্নীতির মতো প্রতিটি অপরাধে কুয়েতে এমপি পাপুলের জেল হতে পারে সাত থেকে ১৪ বছর করে। জানা গেছে, ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই কুয়েত থেকে নিঃস্ব হয়ে ফিরছেন এমপি পাপুলের খপ্পরে পড়া বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকরা।
এমপি পাপুলের লোকজনের নানামুখী নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাদের। সাত-আট লাখ টাকা দিয়ে বিদেশে যাওয়ার পরও ভিসা নবায়ন এমনকি ছুটি নিলেও কমিশন দিতে হতো তাকে। সম্পর্কিত খবর এমপি পাপুলের স্ত্রী-মেয়ে ও শ্যালিকার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাযেভাবে এমপি পাপুল মানবপাচার করতেনলক্ষ্মীপুরে ৬ মাসের শিশুকে জিম্মি করে প্রবাসীর বাড়িতে লুট এরপর অসহায় শ্রমিকদের খাটতে হয়েছে জেলও। পরে কুয়েতে আদালতে সাক্ষী দিয়ে ফেরার সুযোগ পেয়েছেন হতভাগা এসব শ্রমিক।
অন্যদিকে, এমপি পাপুলের ঘুষ-দুর্নীতি, মানব পাচার ও অর্থ পাচারের একের পর এক কাহিনি বেরিয়ে আসায় কুয়েতে ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। কুয়েতের রাজনীতির শীর্ষব্যক্তিরা একের পর এক বক্তব্য দিচ্ছেন বাংলাদেশি ও বাংলাদেশকে নিয়ে। জানা যায়, কুয়েতে গত ৬ জুন আটক হন লক্ষ্মীপুরের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল। তাকে আটকের দুই দিন পর গত ৮ জুন কুয়েতের সিআইডি আটক করে বাংলাদেশি ১২ শ্রমিককে। এই শ্রমিকরা সিআইডির কাছে জবানবন্দি ও কুয়েতের আদালতে সাক্ষী দেয়। পরে গত মঙ্গলবার ভোর রাতে তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিমানবন্দরে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন এসব ভুক্তভোগী শ্রমিক।
তারা জানান, এমপি পাপুলের অভিযোগের ব্যাপারে ১১ প্রবাসী বাংলাদেশির সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ওই ১১ জনের সবাই পাপুলের বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগ আনার পাশাপাশি প্রতি বছর ভিসা নবায়নের জন্য বাড়তি টাকা নেওয়া, প্রতিদিন উপার্জনের একটি অংশ নেওয়ার অভিযোগ এনেছেন।
ফেরত আসা ময়মনসিংহের শাহ আলম এমপি পাপুলের কোম্পানির মাধ্যমে কুয়েত যেতে দিয়েছিলেন সাত লাখ টাকা। মাসিক ১৪০ দিনার বেতনে নির্ধারিত চাকরির কথা বলে নিয়ে যাওয়া হলেও তাকে কুয়েতের এয়ারপোর্টে ব্যাগ ও মালামাল টানার কাজ দেওয়া হয়। শাহ আলম সাংবাদিকদের বলেন, এসব কাজ করলে কুয়েতিরা এক দুই দিনার দিত। এতে প্রতিদিন তেরো, চৌদ্দ দিনার আয় হতো। কিন্তু পাপুলের লোকজনকে এখান থেকে প্রতিদিন দশ দিনার নিয়ে যেত। ফলে সারা দিন কাজ করার পর থাকত দুই দিনার কিংবা তিন দিনার।
টাকা না দিলেই চাকরি চলে যেত। এসবের প্রতিবাদ করলেই তারা নির্যাতন করত, কাজ বন্ধ করে দিত। তিনি বলেন, এই লকডাউনের সময় চার মাস কাজ ছাড়া ছিলাম। আমাদের কেউ দেখতে আসেনি। খাবার দেয়নি। চার পাঁচ দিন না খেয়ে ছিলাম। যারা এমন অবস্থায় কখনো ছিল না, তারা ক্ষুধার যন্ত্রণা কী বুঝবে না। পরে বাড়ি থেকে চল্লিশ হাজার টাকা নিয়ে জীবনটা কোনোরকম বাঁচিয়ে রেখেছি। নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার মো. সোহাগ বলেন, আমি দুই বছর আগে ফকিরাপুল পাপুুল সাহেবের অফিসে সাত লাখ টাকা দিয়ে কুয়েত যাই। আমাদের ১২ ঘণ্টা কাজ ও ১৪০ দিনার বেতন দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কুয়েত যাওয়ার পর ১৭ ঘণ্টা কাজ করতে হয়েছে। আমি একটা মার্কেটে কাজ করেছি। সেখানে সব মিলিয়ে নব্বই থেকে একশ দিনার পেতাম। এর মধ্যে প্রতিদিন পাপুল সাহেবের কোম্পানির লোকজন এসে চার দিনার করে নিয়ে যেত। টাকা না দিলে নির্যাতন করত। এসবের প্রতিবাদ কেউ করতে পারত না। এই লকডাউনের সময় আমাদের কুয়েতের কাবাত মরুভূমির একটি জায়গায় রাখা হয় যেখান থেকে আমাদের সিআইডি ধরে নিয়ে যায়। নওগাঁর আবদুল আলিম দেড় বছর আগে সাত লাখ টাকা দিয়ে কুয়েতে যান পাপুলের কোম্পানির মাধ্যমে।
তিনি বলেন, মার্কেটে ক্লিনার হিসেবে কাজ করতে হতো। ১৬ ঘণ্টা কাজ করে বেতন দিত মাত্র ১০০ দিনার। ভালো কাজের জন্য কোম্পানির অফিসে গেলে নির্যাতন করত। আমাকে দুই দিন নির্যাতন করেছে। খেয়ে না খেয়ে জীবন কাটিয়েছি। সিআইডির কাছে আমরা এসবই বলেছি।
পাপুলের জেল হতে পারে সাত থেকে ১৪ বছর : কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মানব পাচার ও মুদ্রা পাচার, ঘুষ-দুর্নীতির মতো প্রতিটি অপরাধে কুয়েতে এমপি পাপুলের জেল হতে পারে সাত থেকে ১৪ বছর করে। এরই মধ্যে দেশটির তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে এমপি পাপুল স্বীকার করেছেন, কুয়েতে একজন আমলাসহ তিনজনকে ২১ লাখ দিনার অর্থাৎ ৫৭ কোটি ৫৪ লাখ বাংলাদেশি টাকা ঘুষ দিয়েছেন। ঘুষ গ্রহণকারীদের নামও জানিয়েছেন এমপি কাজী শহীদ পাপুল। এরা হলেন- কুয়েতের একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি, অন্যজন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক আমলা আর শেষজন দেশটির এক নাগরিক। আর পাপুলকে মদদ দিয়েছেন দেশটির অন্তত সাতজন বিশিষ্ট নাগরিক। ওই সাতজনের মধ্যে কুয়েতের সাবেক ও বর্তমান তিন এমপিও রয়েছেন।
আরব টাইমস জানিয়েছে, কুয়েতে মানব পাচার নিয়ে বাংলাদেশের এমপির বিরুদ্ধে পাবলিক প্রসিকিউশন যে তদন্ত চালাচ্ছে, তা নিয়ে পরের ধাপের তদন্ত চালাবে দেশটির দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ। এমপি পাপুলের স্ত্রী-মেয়ে ও শ্যালিকার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা : অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের স্বার্থে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল, তার স্ত্রী, মেয়ে ও শ্যালিকাকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে পাপুল এরই মধ্যে বিদেশে অবস্থান করায় তার বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা পাওয়া অন্যরা হলেন- পাপুলের স্ত্রী সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলাম, মেয়ে ওয়াফা ইসলাম ও সেলিনার বোন জেসমিন। গতকাল পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ইমিগ্রেশন বরাবর পাঠানো দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ অনুরোধ করা হয়েছে।
সংস্থাটির পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধানে বিষয়টির প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। দুদকের কাছে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে তথ্য থাকায় এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। এর আগে গত ৯ জুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিনের পাঠানো চিঠিতে পাপুল, তার স্ত্রী, মেয়ে ও শ্যালিকার জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, টিআইএন নম্বর, আয়কর রিটার্নসহ ব্যক্তিগত সব নথিপত্র তলব করা হয়েছিল। এরই মধ্যে কিছু নথিপত্র দুদকে পৌঁছেছে বলে জানা গেছে। তবে সব নথিপত্র এখনো পাওয়া যায়নি।