পর্যটকদের জন্য মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে সিলেটের সাদাপাথর। স্বচ্ছ জলে আনন্দ করতে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন পর্যটকরা। যারা মারা যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগই তরুণ। কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। এ পর্যন্ত ১০ জন পর্যটক বেড়াতে এসে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। চলতি বছরেই মারা গেছেন ৫ জন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সচেতনতা কার্যক্রম বাড়ানো হলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। থামছে না মৃত্যুর মিছিল। সর্বশেষ গত শুক্র ও শনিবার সাদাপাথরে সাঁতার কাটতে গিয়ে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। তলিয়ে যাওয়ার একদিন পর মিলেছে লাশ। সাদা পাথর সিলেটের নতুন পর্যটন স্পট। কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির উজানের অংশের নাম সাদাপাথর। পুরোটাই জিরো পয়েন্ট। সাদা পাথরের সাম্রাজ্য। ভোলাগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দা ও পাথর ব্যবসায়ী আখতারুজ্জামান নোমান মানবজমিনকে জানিয়েছেন, সাদাপাথরের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। জাফলং ও বিছনাকান্দি পর্যটনস্পটে গিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায় সাদাপাথরে এক সঙ্গে দুটো স্থানের আনন্দ উপভোগ করা যায়। কিন্তু এটিকে পর্যটন এলাকা ঘোষণা করে সঠিক মনিটরিং না করার কারণে সাদাপাথরে একের পর এক পর্যটকের মৃত্যু হচ্ছে। কেন হচ্ছে সাদাপাথরে এই দুর্ঘটনা-স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ধলাই নদীর উৎসমুখ সাদাপাথর। উজানে ভারতের ছড়া নেমে এসে ধলাই নদীর সৃষ্টি। উজানের পানি এসে জিরো পয়েন্টে নিচু স্থানে পড়ে স্রোতে পরিণত হয়েছে। এতে পানি ঘূর্ণিতে পরিণত হয়। নদীর তীরে ও তলদেশে অসংখ্য পাথররাজি। সাঁতার কাটতে গিয়ে তরুণ পর্যটকরা ঘূর্ণিতে পড়ে যায়। এরপর তলিয়ে যায় নদীর বুকে। হারিয়ে যায় তারা। পরে মিলে লাশ। এই ঘূর্ণি নিয়েও চিন্তিত স্থানীয় প্রশাসন। কারণ সাদাপাথর নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশাসনও উদ্যোগ কম নেয়নি। কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও বিজন ব্যানার্জী যোগদানের পর সাদাপাথরে পর্যটক নিরাপত্তায় বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। এর মধ্যে পর্যটক নৌকায় ফিরিয়ে আনা হয় শৃঙ্খলা। সাদাপাথরের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে উড়ানো হয়েছিলো লাল ফ্ল্যাগ। পরবর্তীতে জিরো পয়েন্ট এলাকা হওয়ার কারণে সেটি উঠিয়ে নেয়া হয়। পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা করা হয়। ১০ নম্বর ঘাট থেকে নৌকায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকরা পান লাইফ জ্যাকেট। এ ছাড়া পর্যটকদের নিরাপত্তার সতর্কতা জারি করে কয়েকটি সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রায় দুই মাস আগে পরপর তিনজন পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনার পর প্রশাসন এই উদ্যোগ নেয়। ফলে দুই মাসে অঘটন ঘটেনি সাদাপাথরে। কিন্তু একটু শিথিল হওয়ায় ফের পর্যটক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের একটি মাদ্রাসার ১০ম শ্রেণীর ছাত্র হাফিজুর রহমান বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে এসেছিলেন সাদাপাথরে। শুক্রবার বিকালে তারা সাদাপাথরের জিরো পয়েন্টে সাঁতার কাটতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। এরপর থেকে খোঁজাখুঁজি করলেও মিলেনি হাফিজুর রহমানকে। পরদিন শনিবার ধলাই নদীতে ভেসে উঠে হাফিজুরের লাশ। হাফিজুর রহমান বন্ধুদের সঙ্গে সাঁতার কাটছিলেন জিরো পয়েন্টে। ওই এলাকায় স্রোত মিশে ঘূর্ণির সৃষ্টি হচ্ছিলো। সাঁতার কাটার সময় হঠাৎ ঘূর্ণিতে পড়ে যায় হাফিজুর রহমান। তলিয়ে যায় পানির নিচে। এ ঘটনার পরদিন একই এলাকায় ইমানুর রহমান নামের আরো এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। ধলাই নদী সাঁতরিয়ে পূর্ব পাড়ে গিয়েছিলেন ইমানুর। ফেরার পথে তলিয়ে যায় ধলাইয়ের বুকে। প্রায় তিন ঘণ্টা পর নদীতে ভেসে উঠে তার মরদেহ। এ দুটি ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করলেও পর্যটক কমেনি সাদাপাথরে। প্রতিদিন শত শত পর্যটক সিলেট থেকে ছুটে যাচ্ছেন সাদাপাথরে। কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও বিজন ব্যানার্জী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দুর্ঘটনাকবলিত স্থানে সতর্কতামূলক প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নেয়া হবে। একই সঙ্গে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তা বাড়ানোর ব্যাপারেও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর এলাকায় শৃঙ্খলা ফেরাতে লিজ দেয়া হয়েছে। এতে করে কিছু কিছু উন্নয়ন হয়েছে পর্যটন স্পটে। পর্যায়ক্রমে আরো উন্নয়ন করা হবে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামীম আহমদ জানিয়েছেন, পর্যটন এলাকা সাদাপাথরে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয়রাও পর্যটকদের নিরাপত্তায় যতটুকু পারছেন করবেন। স্থায়ীভাবে পর্যটক নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবনায় রয়েছে বলে জানান তিনি।