ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ। ছবি : সংগৃহীত
(প্রিয়.কম) ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ- পীর সাহেব খানকায়ে শায়খ যাকারিয়্যাহ। বর্তমানে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের উপ-পরিচালক এবং তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশন জামে মসজিদে ‘খতীব’ ও জামিয়ার ‘শায়খুল হাদীস’ হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার জন্ম চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানাধীন পানসহি গ্রামে। পিতা মাওলানা মুহাম্মদ মুছা ও মাতা হাশমাতুন নেসা।
তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় গ্রামের সাবাহি মকতব থেকে। পিতাই তার প্রথম শিক্ষক। এরপর সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন রহিমনগর স্কুলে। ১৯৭৫ সালে তিনি বড় কাটারা মাদরাসায় ভর্তি হন এবং ঢাকার ফরিদাবাদ ও চট্টগ্রাম হাটহাজারি মাদরাসায় বিভিন্ন ক্লাসে অধ্যয়ন শেষে ১৯৮৫ সালে ঐতিহ্যবাহী মালিবাগ জামিয়া শারইয়্যা থেকে তাকমিল (স্নাতকোত্তর) সমাপন করেন। এ সময় তিনি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় সমগ্র বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন।
এরই সাথে ১৯৮০ সাল থেকে তিনি ধারাবাহিকভাবে সরকারি দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সকল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. এবং ১৯৯০ সালে এম.এ.-তে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি এম.ফিল প্রথম পর্ব পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পি.এইচ.ডি কোর্সে চলে যান। ২০০০ সালে তার গবেষণা বিশ্ববিদ্যারয় কর্তৃপক্ষ তাকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দীন আহমদ-এর হাত থেকে সম্মাননা লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসায় পড়ুয়া প্রথম আলেম যিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করতে সমর্থ হয়েছেন।
প্রিয়.কম : বাংলাদেশকে সূফি-সাধক বা পীর-আউলিয়ার দেশ বলা হয় কেনো?
ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ : বাংলাদেশে ইসলামের উৎস, শক্তি, লালন ও বিকাশ- এই সব তলোয়ার দ্বারা হয়নি বরং এর সবটুকুই হয়েছে সূফি-সাধক বা পীর-আউলিয়াদের সাধনার দ্বারা। এই জন্য বাংলাদেশকে সূফি-সাধক বা পীর-আউলিয়ার দেশ বলা হয়।
প্রিয়.কম : বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে শরিয়তপন্থী ও তরিকতপন্থী বলে মুসলমানদের মধ্যে একটা বিভাজন রয়েছে। শরিয়তপন্থীদের দাবি, পরকালীন মুক্তির জন্যে শরিয়ত মেনে চলা ছাড়া উপায় নেই। তরিকতপন্থীরা মনে করে, তরিকত চর্চাই ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির সোপান । কারও মতে শরিয়ত ও তরিকত এই দুয়ের সম্মিলনের নাম ইসলাম। এ ব্যাপারে যদি কিছু বলতেন?
ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ : শরীয়তকে তরীকত বানানো অতি জরুরি বিষয়। এটা ছাড়া মূল শরীয়তের নূর স্থায়িত্ব পায় না। মূল কথা হলো- উভয়টিই জরুরি। বিষয়টা অনেকটা অজু ও নামাজের মতো। কোনোটাকেই বাদ দেয়ার উপায় নেই। নামাজ পড়তে হলে অজু জরুরি। আবার অজু করা হয় নামাজের জন্যেই। তবে এক্ষত্রে মনে রাখতে হবে- আগে শরীয়ত, তারপর তরীকত।
প্রিয়.কম : আধ্যাত্মিক চর্চার নামে সারা বাংলাদেশে এমন অনেক মাজার ও খানকায় ব্যাপক অনৈতিক, অশ্লীল ও অসামাজিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয় এবং মাদক ও নেশার ছড়াছড়ি দেখা যায়। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য জানতে চাচ্ছি?
ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ : মাজার বরকতের স্থান বাণিজ্যকেন্দ্র নয় এবং এই স্থানকে কোনো বিনোদনস্থল বানানো ঠিক না। কিন্তু এ বরকত আহরণ করতে হবে শরীয়তের নিয়ম অনুসারে। এটা খুব স্পর্শকাতর অংশ। দুর্ঘটনা হলে ঈমান-আমল সব বরবাদ হয়ে যায়।
প্রিয়.কম : একজন মানুষ কেনো আধ্যাত্মচর্চায় নিয়োজিত হবেন?
ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ : আধ্যাত্মবাদের চর্চা মানুষের জন্য অত্যন্ত জরুরি। মানুষকে দেওয়া হয়েছে নফস-আত্মা। এটা কেবল মানুষেরই আছে, ফেরেশতার নেই। অধ্যাত্মবাদ চর্চা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে এই নফস দমিত হয় না। এ জন্যই তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধি করাকে ফরজ করে দেয়া হয়েছে।
ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ রচিত কিছু বই। ছবি : সংগৃহীত
প্রিয়.কম : একজন খাঁটি পীরের মধ্যে কী কী গুণাবলি বা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা থাকা জরুরি?
ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ : খাঁটি হওয়ার তো কোনো শেষ নেই। যে ব্যক্তি ঈমান, আকীদা, ইত্তিবায়ে শরীয়ত, সুন্নাহ, ইশক, মুহাব্বত, জিকির, মোরাকাবা ইত্যাদির ক্ষেত্রে নবী [সা.]-এর যতো কাছে, সে তত খাঁটি পীর। আবার যার মধ্যে বিদয়াত ও বে-শরমীর কাজ যতো বেশি, সে ততোই অ-খাঁটি ও ভেজালযুক্ত।
প্রিয়.কম : বাংলাদেশে অনেক পীরের দরবারে দেখা যায়, মুরীদরা তাদের পীর সাহেবকে সেজদা করেন। তারা বলেন, এটা তাজিমের সেজদা। অথচ ইসলামের শিক্ষা হলো, আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সেজদা করা যাবে না। কোনো কোনো ইসলামি স্কলার এই ধরনের সিজদা করাকে শিরক বলেছেন। এই বিষয়টি একটু বুঝিয়ে বলুন।
ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ : আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সেজদা করা হারাম। সুতরাং কোনো পীরকে সেজদা করাও সম্পূর্ণ হারাম। সেজদার দিকে যায়- এমন কিছু করা হলে তা-ও হারাম। আর এই কারণেই কদমবুচি করাও আপত্তিকর বলে মনে করা হয়। আমাদের নবীর (সা.) থেকে আমরা কী পেয়েছি? পেয়েছি সালাম, মুসাফা এবং ক্ষেত্র বিশেষ মোয়ানাকা। এর থেকে বেশির তো দরকার নেই।
প্রিয়.কম : কোনো কোনো পীর সাহেবদের বলতে শোনা যায়, যার পীর নেই, তার পীর শয়তান। পীর-মুর্শিদরা তাদের মুরীদদের সুপারিশ করে জান্নাতে পৌঁছে দেবেন। তাহলে হাজার-কোটি মুসলিম যারা পীর-মুরীদির পথে নেই বা কোনো পীরের অনুসারী নন, তারা কি জান্নাতে যেতে পারবেন না?
ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ : যার পীর নেই, তার পীর শয়তান- এভাবে না বলে তারা কথাটা এইভাবে বলতে পারতেন যে, সব মানুষেরই পীর আছে। পীর মানে হচ্ছে, পথ প্রদর্শক। পীর মানে শিক্ষক। আর সুপারিশ করবেন নবীরা, সাহাবিরা, তাবেঈরা, আলেমরা, হাফেজরা এবং হাজিরা। এই সুযোগ তো শুধু পীরের জন্য নয়; এটা উল্লেখিত শ্রেণিভূক্ত সবার জন্যই সমান।
প্রিয়.কম : নারীদের আধ্যাত্মবাদ বা আত্মশুদ্ধির চর্চার উপায় কী? এ সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা কী?
ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ : আত্মশুদ্ধির চর্চার মূলকথা হচ্ছে নিজেকে তৈরি করা। এটা যেমন পুরুষের জন্য দরকার, তেমনই নরীর জন্যও দরকার। হজরত আয়েশা [রা.] বলেন, আজকে যে-পদ্ধতিতে পীরেরা বায়াত করান, আলেম উলামাগণ এটা নবীজী (সা.) কর্তৃক নারীওদর মুরিদ করার ঘটনা থেকে গ্রহণ করেছেন। আর এটাকে বলা হয় বাইয়াতুন্নেসা।
নারীরা বাইয়াত করবে কিন্তু তারা শরীয়তের সীমানা থেকে বের হতে পারবে না। কেননা, নবী [সা.] বাইয়াতের সময় কোনো নারীর হাত ধরেন নি এবং মুরিদ হওয়ার কারণে তার সাথে পর্দার বিধান রহিত হয়নি।
ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ একই সঙ্গে শিক্ষক, গবেষক, লেখক, হাদীস বিশারদ, মুফাসসির, তাত্ত্বিক আলোচক ও সর্বোপরি একজন নিষ্ঠাবান বুজুর্গ আলেম। নানুপুরী পীর শায়খ জমির উদ্দীন-এর সঙ্গে রয়েছে তার আধ্যাত্মিক সম্পর্ক। তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তাহরীকে দেবন্দ’, ‘শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী’ ছাড়াও তিনি আহকামে ইসলাম, স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেমদের ভূমিকা প্রভৃতি বিষয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা বর্হিবিশ্বেও ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে এবং মাদারাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকায় স্থান পেয়েছে।
প্রিয়.কম : অলি-আউলিয়াদের কারামত সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন!
ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ : অলি-আউলিয়াদের কারামত সত্য। এটা স্বত:সিদ্ধ কথা। কারামতের বিষয়টা সাহাবির মর্যাদা কিংবা তাবেঈ ও তাবেতাবেঈনের মর্যাদা থেকে অনেক নিচে। নবী [সা.] বলেছেন, নবুওয়াত খতম হয়েছে কিন্তু নবুওয়াতকে ধরে রাখার জন্য আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত রাখার রাস্তাটা উম্মুক্ত।
আল্লাহপাক আউলিয়াদের কারামত দিয়েছেন, এটা মুজেযারই একটি অংশ। মুজেযা নবীদের জন্য, আর কারামত অলিদের জন্য। কারামত কেউ ইচ্ছা করে দেখাতে পারে না, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তার মাধ্যমে কারামত দেখান। কারামত প্রচার করার বিষয় নয় বরং এটা লুকিয়ে রাখার বিষয়। কেউ যদি কারামত প্রচার করে তাহলে সেটা তার জন্য নেগেটিভ। বুঝতে হবে, প্রচারটা সে হয়তো তার বুঝের কমতি কিংবা তার বেলায়েতের কমতি কারণে করছে। আর একটা বিষয় হলো, যাদের কম কারামত তাদের বুযুর্গি বেশি, আর যাদের বেশি বুযুর্গি তাদের কারামত কম।
প্রিয়.কম : প্রকৃত পীর চেনার উপায় কী কী? অনেক উলঙ্গ কিংবা অস্বাভাবিক আচরণকারী পীরকে আমাদের সমাজে দেখি, তাদের কি পীর বলা যায়?
ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ : প্রথম কথা হচ্ছে, যার কাছে গেলে মউত, কবর এবং হাশর-মিজানের প্রতি যতো আকর্ষণ বৃদ্ধি পাবে, সে ততো হক্কানী পীর। এটা হচ্ছে প্রথম আলামত। দ্বিতীয় হলো, তার কথা কুরআন-সুন্নাহের পরিপন্থী হবে না। তৃতীয়, প্রকৃত পীরের কাছে সমকালীন হক্কানী আলেমদের যাতায়াত বেশি হবে। চতুর্থ, তার সাথে যারা জড়িত তাদের তিনজনের মধ্যে দুইজনই আল্লাহর পথে থাকবে। এই রকম আরও প্রায় ১৫টা গুণাগুণ আছে।
একটি কথা মনে রাখতে হবে, একটা হলো মজযুব আরেকটা হচ্ছে মজনুন। মজযুব সম্মানিত। আর মজনুন জাহান্নামি। সব কিছুকে এক করলে হবে না। মজনুন হলো, যারা নানা অনৈতিক কাজে তাদের জীবনের স্বাভাবিকতাকে হারিয়ে ফেলে এবং শেষ বয়সে এসে উম্মাদ হয়ে যায়। আর মজযুব হলো, যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্ধান করার পথে গিয়ে পাগল হয়েছে, যিনি আরেফ, কুতুব, কুতবেশাহ, কুতবেমানার।
সম্পাদনা: গোরা
পাঠকের মন্তব্য(০)
মন্তব্য করতে লগইন করুন