বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের এক নির্জন দ্বীপ। নিকটস্থ হাসপাতাল থেকে বেশ কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে এর অবস্থান। সেখানে বসবাস করেন আবদুল জলিল (৬৭)। তিনি মনে করতেন অন্ধ হয়েই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। কিন্তু তার সেই ধারণা পাল্টে গেছে এ মাসের প্রথমদিকে। ওই সময় তার বাড়ির পাশে নোঙর করে একটি জাহাজ। বিনামূল্যে ৬৭ বছর বয়সী জলিলের চোখের ছানি অপারেশন করা হয়। তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, কখন আমার চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হবে, তার জন্য আর তর সইছিল না। ঠিকমতো আমার ছেলেকে শেষ কবে দেখেছি! সে অনেক আগের কথা। ভুলেই গিয়েছি দেখতে কেমন সে। ওই প্রতিবেদনে চরের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার নানা সমস্যার কথা উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে প্রধান শিকারে পরিণত হচ্ছে তারা। যমুনা নদীর বুকে বালু আর পলিমাটি জমা হয়ে দুই দশক আগে সৃষ্টি হয়েছে একটি দ্বীপ। সেখানেই বসবাস করেন আবদুল জলিল। বাংলাদেশে এসব দ্বীপ চর নামে পরিচিত। নিয়মিত এসব চরে ভাঙন চলে আবার গড়ার কাজও চলে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরমভাবাপন্ন বৃষ্টির কারণে এ ঘটনা ঘটে দ্রুততার সঙ্গে। নদী ভাঙন চরের বাসিন্দাদের বেঁচে থাকাকে জটিল করে তোলে। গবেষকরা বলছেন, এই নদী ভাঙনের কারণে সেখানে স্থায়ী কোনো হাসপাতাল নির্মাণ করা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ভাসমান হাসপাতাল, যা জাহাজে পরিচালিত হয়, তা পরিচালনা করে একটি বেসরকারি সংগঠন। তাতে রয়েছে চিকিৎসা সুবিধার সরঞ্জাম। আছেন ডাক্তাররা। এ থেকে এমন চরে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়। জলবায়ু পরিবর্তনে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে এমন অন্য দেশগুলোর কাছে এটা হতে পারে একটি মডেল। জাহাজ ছাড়া চরের অধিবাসীদের ভাড়া করতে হয় বোট। তারপর নিকটস্থ হাসপাতালে সারাদিনের সফর শেষে পৌঁছাতে হয়। এনজিও ফ্রেন্ডশিপ-এর প্রধান কাজী গোলাম রসুল এ কথা বলেছেন। তিনি আরো বলেন, শুধু একজন ডাক্তারের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য এসব চরের মানুষদের প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হয়। এতে অনুৎসাহিত হন তারা। তাই যখন রোগ বা ব্যথা অসহনীয় অবস্থায় চলে যায়, তখনই এসব অধিবাসীরা হাসপাতালে যান। বিষয়টি অত্যন্ত বিপজ্জনক। ওই এনজিওটি বর্তমানে দু’টি জাহাজ পরিচালনা করে। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরো পাঁচটি। এতে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরবের সংগঠন কিং আবদুল্লাহ ফাউন্ডেশন। পাঁচ বছর পরে নতুন জাহাজগুলো বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নওশের আহমেদ শিকদার বলেন, যেসব মানুষের কাছে পৌঁছানো কঠিন এবং তারা চিকিৎসা সেবা পান না তাদের জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খুবই বিপর্যকর অবস্থায়। গবেষকরা বলছেন, যেসব মানুষ মূল জনপদ থেকে অনেক দূরে চরে বসবাস করেন জলবায়ুুর পরিবর্তন, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে সবার আগে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। সরকারি রেকর্ড বলছে, গাইবান্ধার চরে বসবাস করছেন কমপক্ষে ৪৬৬টি পরিবার। তারা নদী ভাঙনে বাড়িঘর হারিয়েছেন। ৬৭টি পরিবার অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ন্যাশনাল চর এলায়েন্সের মতে, সব মিলিয়ে বাংলাদেশের চরগুলোতে বসবাস করেন প্রায় এক কোটি মানুষ। ২০০২ সালে ফ্রেন্ডশিপ প্রতিষ্ঠা করেন রুনা খান। তিনি বলেন, এখানে জীবন ও মৃত্যু পাশাপাশি অবস্থান করে। একজন কৃষক তার জমিতে সবটুকু অর্থ বিনিয়োগ করেন। আশা ভালো ফলন পাবেন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন তার কাছ থেকে এর সবটাই কেড়ে নেয়। তিনি যা সঞ্চয় করেছিলেন মাত্র এক সেকেন্ডের মধ্যে তা শেষ হয়ে যায়। তিনি আরো বলেছেন, গত দুই দশকে তার সংগঠন দেখতে পেয়েছে বিভিন্ন মৌসুম ছাড়াও রোগ দেখা দিচ্ছে। এই সমস্যাকে মোকাবিলা করার জন্য রুনা খান তিন স্তরের ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে রোগীকে জাহাজে নেয়া, মেডিকেল টিম চরে পাঠানো চেকআপ করতে, সচেতনতা বাড়াতে চরের নারীদের প্রশিক্ষণ ও ওষুধ দেয়া। রুনা খান বলেন, শহরের মতো স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা আপনি এসব চরে পাবেন না। কারণ, এসব চর অস্পৃশ্য। জলবায়ু বিষয়ক বিজ্ঞানী সলিমুল হক বলেছেন, হাসপাতাল জাহাজের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার ধারণা ও চর্চা খুবই ভালো একটি উদ্যোগ।