যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়, যে ছিল হৃদয়ের আঙ্গিনায়, সে হারালো কোথায় কোন দূর অজানায়- নিজের কালজয়ী এই গানের মতো করেই চিরতরে হারিয়ে গেলেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ। অগণিত ভক্তকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে বিদায় নিলেন বাংলা সংগীতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র। শনিবার রাত সাড়ে ১১টায় বারিধারায় নিজ বাসায় শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় শাহনাজ রহমতুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৬৫ বছর। গতকাল বাদ জোহর বারিধারায় পার্ক মসজিদে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে বনানীর সামরিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। খ্যাতিমান এ শিল্পীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শাহনাজ রহমতুল্লাহর বিদায়ে সংগীত তথা পুরো সংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পরিণত হয় শোকের বইয়ে। মৃত্যুর পর পরই শাহনাজ রহমতুল্লাহর বাসায় তার সহকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও ভক্তরা ভিড় করতে থাকেন। তার পরিবারের পক্ষ থেকে নৃত্যশিল্পী ডলি ইকবাল জানান, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। তার স্বামী মেজর (অব.) আবুল বাশার রহমতুল্লাহ একজন ব্যবসায়ী। মেয়ে নাহিদ রহমতুল্লাহ থাকেন লন্ডনে আর ছেলে এ কে এম সায়েফ রহমতুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্র থেকে এমবিএ করে এখন কানাডায় থাকেন। একুশে পদকসহ বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন বরেণ্য শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ। ১৯৯২ সালে তাকে একুশে পদক দেয়া হয়। ১৯৯০ সালে ‘ছুটির ফাঁদে’ ছবিতে গান গেয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। এ ছাড়া ২০১৬ সালে ‘চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’ আয়োজনে আজীবন সম্মাননা, ২০১৩ সালে সিটি ব্যাংক থেকে গুণীজন সংবর্ধনা দেয়া হয় তাকে। বাংলাদেশের সংগীতে যে কজন শিল্পী নিজের গানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন তাদের মধ্যে শাহনাজ রহমতুল্লাহ অন্যতম। তার জন্ম ১৯৫৩ সালের ২রা জানুয়ারি ঢাকায়। মাত্র ১০ বছর বয়স থেকেই গান শুরু করেন। অবাক করার বিষয় হলো প্রায় সেই বয়স থেকেই তিনি গান করেন চলচ্চিত্র, টেলিভিশন আর বেতারে। খেলাঘর থেকে শুরু করা এ শিল্পীর কণ্ঠ সে সময়ই ছিল পরিণত। গজল সম্রাট মেহেদি হাসানের শিষ্য হয়েছিলেন তিনি। তার কাছেই তার গানের তালিম নেয়া। ধীরে ধীরে শাহনাজ রহমতুল্লাহর নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অল্প বয়সেই তারকাখ্যাতি পান তিনি। বাংলাদেশের দেশাত্মবোধক গানের দিকটা ধরতে গেলে সবার আগেই চলে আসে শাহনাজ রহমতউল্লাহর নাম। তাছাড়া চলচ্চিত্রের গানেও ব্যাপক সফলতা লাভ করেন তিনি। ১৯৬৩ সালে ‘নতুন সুর’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু হয় তার। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে অনেক চলচ্চিত্রে তার গাওয়া গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘যে ছিলো দৃষ্টির সীমানায়’, ‘আমায় যদি প্রশ্ন করে’, ‘কে যেন সোনার কাঠি’, ‘মানিক সে তো মানিক নয়’, ‘যদি চোখের দৃষ্টি’, ‘সাগরের তীর থেকে’, ‘খোলা জানালা’, ‘পারি না ভুলে যেতে’, ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে’সহ আরো অনেক গান। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া গানই চারটি। এগুলো হলো ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিতে খান আতাউর রহমানের কথা ও সুরে ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথা ও আনোয়ার পারভেজের সুরে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’ ও ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে? এবার বল’। শাহনাজ রহমতুল্লাহর ভাই আনোয়ার পারভেজ ছিলেন প্রখ্যাত সুরকার, আর আরেক ভাই চিত্রনায়ক জাফর ইকবাল। তিনিও গান করতেন। গানের ক্ষেত্রে তাদের মায়ের অনুপ্রেরণাই ছিল বেশি। ক্যারিয়ারের ৫০ বছর পূর্তির পর গান থেকে বিদায় নেন খ্যাতিমান এ শিল্পী। এর অন্যতম কারণ ছিল ধর্মেকর্মে মনোযোগী হওয়া। গান ছাড়ার কারণ হিসেবে তিনি তখন বলেছিলেন, ওমরাহ করে আসার পর আর গান করতে ইচ্ছা করেনি। আমি নামাজ পড়া শুরু করেছি। নামাজ পড়েই সময় কাটছে। ৫০ বছরের ওপরে গান গেয়েছি, মানুষের কাছ থেকে অপরিমেয় ভালোবাসা পেয়েছি। আমেরিকাতেই গান করতে গিয়েছি ২০ বার। আর কত গাইব? গান ছাড়ার পর এ মাধ্যমটি থেকে দূরে থাকলেও অনুজদের সব সময় অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন এ শিল্পী।