শুধু বামপন্থী সিপিবিতে নয়, দোদুল্যমানতা ছিল ইসলামবাদী হেফাজতে ইসলামের মাঝেও। ফলশ্রুতিতে একেবারে শুরুতেই তারা আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করে। হেফাজত বোঝার চেষ্টা করছিল এর গতিধারা কোন দিকে যাবে। যখন তারা নিশ্চিত হয় সরকারের পক্ষে আর টিকে থাকা সম্ভব হবে না, তখন একেবারে শেষমুহূর্তে এসে তারা আন্দোলনে যোগ দেয়।
হেফাজতের মাঝে দোদুল্যমানতা থাকলেও আন্দোলনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলোর মাঝে কোনো সংশয় ছিল না। খেলাফত মজলিস তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তাদের দলীয় কৌশল অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে যাতে সরাসরি সংঘাতে লিপ্ত হতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করে আন্দোলনে অংশ নেয়।
জামায়াতে ইসলামী তাদের কর্মী, সমর্থকদের যতটা বেশি সংখ্যক সম্ভব এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা যায় ওই ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। তবে বিএনপির তুলনায় ছোট দল হবার কারণে বিএনপির সমতুল্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি; যদিও সরকার পতনের ব্যাপারে তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভূমিকা রেখেছে হিযবুত তাহরীরও।
হিযবুত তাহরীরের মিডিয়া সমন্বয়ক ইমতিয়াজ সেলিম সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, “হিযবুত তাহ্রীর একটা ইন্টেলেকচুয়্যাল এবং পলিটিক্যাল লিডিং ফোর্স।” তার ভাষ্য অনুযায়ী, সরকার পতনের আন্দোলনে হিযবুতের কর্মীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠনটির কর্মীরা সংগঠনের ব্যানার ছাড়াই মাঠে ছিল। এসব দাবির সত্যতা প্রমাণ করা কঠিন হলেও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে হিযবুতের নেতাকর্মীরা তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে মাঠে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক।
তবে শুধু হিযবুত নয়, কোনো দল বা সংগঠনই তাদের ব্যানার নিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়নি। এটি বাংলাদেশের সরকারবিরোধী আন্দোলনের একটি নতুন প্রপঞ্চ। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলে যত রাজনৈতিক বা সরকার পতনের আন্দোলন হয়েছে এর সবকিছুই হয়েছে রাজনৈতিক দল বা ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে।
বিশ্বের অন্য যে কোনো জায়গায় যত বিপ্লব হয়েছে, তার সবই হয়েছে রাজনৈতিক ব্যানারে, সুস্পষ্ট একটা রাজনৈতিক লক্ষ্য সামনে রেখে। তাহলে, বাংলাদেশে কেন দলীয় ব্যানারে, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য বা মতাদর্শকে সামনে রেখে সরকারের পতন ঘটানো গেল না? সরকার পতনের আন্দোলনকে কেন একটা আপাত ‘অরাজনৈতিক’ চেহারা দিতে হলো?
এর থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে বিদ্যমান কোনো একক রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি ওই পরিমাণ জনসমর্থন নেই যার মাধ্যমে বেশিরভাগ জনগণকে একটি সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন সংগঠিত করা যায়। এ জনসমর্থনহীনতার কারণেই অরাজনৈতিক ব্যানারে আন্দোলন দাঁড় করাতে হয়েছে, যাতে আওয়ামী লীগ বাদে সমস্ত মতাদর্শ সমর্থনকারীরা এ আন্দোলনে শরিক হতে পারে।
অরাজনৈতিক ব্যানারে হলেও জুলাই বিপ্লবের একটি রাজনীতি আছে, একটি রাজনৈতিক বার্তা আছে, আছে রাজনৈতিক লক্ষ্যও। সব বিপ্লবেরই সেটা থাকে। রুশ বিপ্লবে সেটা ছিল বলশেভিকদের (কমিউনিস্ট পার্টি) নেতৃত্বে সামন্ততান্ত্রিক রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর। ইরানের বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল পাহলভি রাজবংশের উৎখাত করে ইরানকে শিয়া ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করা। রুশ, চীন বা ইরানের বিপ্লবের মতো স্পষ্ট এবং ঘোষিত লক্ষ্য না থাকলেও জুলাই আন্দোলনেরও নির্দিষ্ট বার্তা এবং লক্ষ্য ছিল, যা গণমানুষকে শেখ হাসিনা সরকারের উচ্ছেদের লড়াইয়ে সামিল করেছে।