বাংলাদেশ ও ভারত– এই দুটি দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত অনেক মিল শক্তিশালী বন্ধনের ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও সম্পর্ক এখন অবিশ্বাস ও সন্দেহের হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘চেইন রি-অ্যাকশন”-এর মতো নানা পাল্টা-পাল্টি অপঘটনা সংগঠিত হচ্ছে, বাড়ছে দূরত্ব।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতের অবদান অনেক। সেই সময়ের ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বজুড়ে জনমত গঠন, এক কোটি উদ্বাস্তুকে ভারতে ঠাঁই দেওয়া এবং বাংলাদেশের যুদ্ধে তার দেশের সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়ে যে সহযোগিতা করেছেন, তা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান পেয়েছে।
কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতনের পর থেকে দেশে দুটির মধ্যে যে বৈরিতা তৈরি হয়েছে এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও দেশের জনগণকে যেভাবে হেয় করা হচ্ছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক, জেনিভা কনভেনশন লঙ্ঘন করে ভারতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোতে হামলা একান্তভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত।
বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা সীমিত করে দেওয়ার মাধ্যমে দেশ দুটির জনগণের মধ্যে পারস্পরিক আদানপ্রদান, যোগাযোগ যেভাবে কমিয়ে দেওয়া হযেছে, তাতে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক থাকবে কিন্তু হৃদ্যতা ও ভবিষ্যতে উভয় দেশের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কটি কি থাকবে? সম্পর্ক উষ্ণ না হলে উভয় দেশ যেসব আন্তর্জাতিক জোটের সাধারণ সদস্য, যেমন সার্ক, বিমসটেক, আইওরা ও কমনওয়েলথ– সেসব চুক্তিগুলো ঠিকমত কার্যকর করা সম্ভব হবে না।
ইতোমেধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অমীমাংসিত নানা বিষয় নিয়ে যে টানাপোড়েন রয়েছে, যেমন সীমান্তে নিরীহ মানুষ হত্যা, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন না করা, তীব্রমাত্রার বাণিজ্য বৈষম্য বাংলাদেশের বিপক্ষে থাকা, সেগুলোর সমাধান না হওয়াতে এই সম্বন্ধ নিয়ে একধরণের দ্বেষ তৈরি হয়েছে। এখন পৃথিবীর প্রায় সব দেশই বাণিজ্য ও অন্যান্য বিষয়ে পরস্পরের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল এবং বাণিজ্যকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য, তাই পেঁয়াজ-রসুন রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া বা ভারতীয় ডাক্তার বাংলাদেশীদের চিকিৎসা দেবেন না– এসব বিষয় সম্বন্ধ রক্ষার ক্ষেত্রে শিষ্টাচার বহির্ভূত বলে মনে হয়।
বাংলাদেশের প্রতি অসংবেদনশীলতা নয়
বাংলাদেশ-ভারতের ভূরাজনৈতিক অবস্থান পৃথিবীতে এমন গুরুত্ব তৈরি করেছে যে পাশাপাশি অবস্থান করে দূরত্ব তৈরি করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে টানাপোড়েনের কারণে এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ একটি সংগঠন সার্ক অকার্যকর হয়ে রয়েছে। তাই অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ এশিয়ান নেশনস যখন বাণিজ্য ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নিজেদের ঘোড়দৌড়ের মাধ্যমে এগিয়ে নিচ্ছে, তখন আমরা সার্কভুক্ত দেশগুলো তিন-পায়া দৌড়ে সামিল হচ্ছি। উভয় দেশের মধ্যে সংখ্যালঘুদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা ও সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়ে রাজনৈতকি ফায়দা নেওয়ার অপচেষ্টার দিন শেষ। তাই, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও তাকে সাম্প্রদায়িক তকমা দেওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।
ভারত একতরফাভাবে ভিসা বন্ধ ও কোন কোন শুল্কবন্দর বন্ধ করে বাংলাদেশের ওপর যে মানসিক চাপ প্রয়োগ করতে চেয়েছিল, তা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হযেছে। কলকাতার আবাসিক হোটেলগুলো সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে তারা বাংলাদেশী পর্যটকদের চায়। এখন তাদের ব্যবসায় ধস নেমেছে। এমন একটি পরিপ্রেক্ষিতে ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। তিনি ফরেন অফিস কনসালটেশনের (এফওসি) জন্য ঢাকায় এসে একাধিক বৈঠকে শামিল হন।
অগাস্ট মাসের ৫ তারিখে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এই প্রথম ভারতের কোনো কূটনৈতিক বাংলাদেশে এলেন। বোঝাই যাচ্ছে গত চার মাসে দুদেশের মধ্যে যেসব কণ্টকময় বিষয়ের অবতারণা ঘটেছে, সেসব বিষয়ে আলোকপাত ও সংকট নিরসনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে ভারত। বিক্রম মিশ্রি বলেন, “আমি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কিত আমাদের উদ্বেগগুলো (বাংলাদেশকে) জানিয়েছি। আমরা সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও কূটনৈতিক সম্পত্তির ওপর হামলার কিছু দুঃখজনক ঘটনা নিয়েও আলোচনা করেছি।”