‘সুখী হওয়া খুব সোজা কিন্তু সোজা হওয়া খুব কঠিন’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ছোটবেলায় শুনতাম অমুকের মতো হও, তমুকের মতো হতে নেই। কলেজে পা ফেলে দেখি কেউ মহানায়ক উত্তম কুমারের মতো চুল ছাঁটে, কেউ নায়িকা মধুবালা কিংবা নার্গিসের মতো করে হাসতে গিয়ে হাসির খোরাক হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে দেখি পিকিং, মস্কো, ওয়াশিংটনপন্থীদের প্রচণ্ড পদচারণা; বাঙালিপন্থীও ছিল পাশাপাশি।
পেশাজীবনে পেলাম বাংলাদেশের প্রতি পরামর্শ—দক্ষিণ এশিয়ার দেশের মতো হও। এর কথা, ওর কথা শুনতে শুনতে নীতিনির্ধারকদের অবস্থা মান্না দের গাওয়া সেই বিখ্যাত গানের মতো, ‘আমি কোন পথে যে চলি, কোন কথা যে বলি/তোমায় সামনে পেয়েও খুঁজে বেড়াই মনের চোরাগলি/সেই গলিতেই ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে দেখি/বন্ধু সেজে বিপদ আমার দাঁড়িয়ে আছে একি...।’
দুই.
আগামী এক দশকের মধ্যে উঁচু-মধ্য আয়ের দেশ এবং দুই দশকের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ সামনে এগোচ্ছে—অন্তত বিগত সরকারি পরিকল্পনায় এবং ধীমানদের ধ্যান-ধারণায় এমনই ইঙ্গিত মেলে। সন্দেহ নেই যে লক্ষগুলো প্রেরণাদায়ক, তবে উদ্দীপ্ত উদ্দেশ্যে পৌঁছাতে নির্দিষ্ট পথ পরিষ্কারভাবে জানান দেওয়া হয়নি।
করণীয় হিসেবে আরো দরকার অন্ধ অনুসরণ নয়, বরং বাংলাদেশের নিজস্ব ‘মডেলে’র ওপর ভর করে সামনের সমস্যাসংকুল পথ পাড়ি দেওয়া।
কিছুকাল আগে কোনো এক কনফারেন্সে এমনটাই বলেছিলেন প্রখ্যাত অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ (বর্তমান শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা)। তার মতে, বাংলাদেশের আগামী স্বপ্ন পূরণ করতে বাংলাদেশভিত্তিক সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য এবং পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। আজকের এই নিবন্ধ তার বক্তব্যের নির্যাস হিসেবে নিবেদন করা হলো।
তিন.
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিষয়ক অধ্যয়ন স্বীকার করে নিয়েছে যে উন্নয়নশীল দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন একটি সাধারণ ঘটনা, তবে টেকসই হওয়া ব্যতিক্রম। তাই উপলব্ধ উল্লাস উদযাপনের আগে সতর্ক দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়। বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে উন্নয়নের বিদ্যমান ব্যাখ্যায় ‘এশিয়ার উদীয়মান বাঘ’-এর মতো হওয়ার অবারিত উপদেশ অহর্নিশ আসতে থাকল। অবস্থা অনেকটা যেন ১৯৬৫ সালে রক ব্যান্ড বিচের গাওয়া একটি গানের মতো ‘ওরা সবাই যদি ক্যালিফোর্নিয়ার মেয়ে হতো’।
কিন্তু সবাই তা হয় না।
শুধু তা-ই নয়, সম্ভবত অধিক সময় ব্যয় করা হয়েছে এমনতর ‘উপচিত’ উপদেশ উদগিরণে। অথচ এর বিপরীতে অপেক্ষাকৃত অনেক কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জাপানের অভিজ্ঞতা সিঞ্চনে। এই দেশটি ১৯০০ সালে আর্জেন্টিনার সমান মাথাপিছু আয় নিয়ে আকাশচুম্বী উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ চীন হয়তো অনুকরণীয় মডেল হতে পারত, কিন্তু বাজার অর্থনীতি আলিঙ্গনের পর থেকে দেশটিতে প্রবৃদ্ধি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে অসমতাসূচক আয়বৈষম্য। এখন বিদিশায় পড়া দেশটি বড় বড় ব্যবসা দমন করতে উঠেপড়ে লেগেছে। অথচ এর সম্পূর্ণ বিপরীত জাপানের অভিজ্ঞতা। শ্রমিকদের কল্যাণ ও আনুগত্যের মিলন ঘটিয়ে, যাকে বলে ‘জাপানের মূল্যবোধ’—জাপানের ব্যাবসায়িক মডেল প্রবৃদ্ধিকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ন্যায়সংগত রাখতে সক্ষম হয়েছে। আর সে জন্যই বোধ হয় জাপানে ধনী লোক বেশি, কিন্তু বিলিয়নেয়ার হাতে গোনা কয়েকজন (যুক্তরাষ্ট্রের ৬৭৫ এবং ভারতের ১৭৫-এর বিপরীতে মাত্র ২৫!)। সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশে যত উঁচু প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তত বিলিয়নেয়ার বাড়ছে; বিলিয়নেয়ার নিয়ে অসম প্রবৃদ্ধির পথে হাঁটছে বাংলাদেশ।
চার.
সফলতার সব গল্পে অবশ্য কিছু মিল পাওয়া যায়; যেমন—লিও তলস্তয় বলেছেন, ‘সুখী পরিবার সব একই রকম।’ মিলটি হলো এই যে একটি কল্যাণকর সমাজ বিনির্মাণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা, যা অর্থনৈতিক উদ্যোগ উৎসাহিত করবে। এই ‘সহায়ক পরিবেশ’ দেশভেদে ভিন্নতর হতে পারে, তবে আমাদের কাছে মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন—বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন উপাদান কী হতে পারে?
প্রথমত, এলডিসি-পরবর্তী জামানার চ্যালেঞ্জ উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতকালের প্রাধিকারমূলক প্রাপ্তি ছাড়া কেমন করে দেয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দর-কষাকষি করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করা যায়, তার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। এবং তা এখন থেকেই। কেউ হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই, বরং আমাদের বাণিজ্য অংশীদাররা যার যার মতো করে এক বা একাধিক আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য এলাকায় এরই মধ্যে ঢুকে পড়েছে। দৌড়ঝাঁপ লেগে গেছে দোর খুলে দেওয়ার জন্য। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার যে মুক্তবাণিজ্য এলাকায় প্রবেশের পথ বড় কঠিন। যেমন সময়ের দিক থেকে দীর্ঘ, তেমনি এর জন্য বিশেষজ্ঞের মূল্যাবধারণ প্রয়োজন। আর একটি কথা, আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য ব্যবস্থার ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের অন্তর্দৃষ্টি ভালো এমন একটি ভুল ধারণার ওপর ভর করে অনেক সময় সরকার নিষ্কপট নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এই গোষ্ঠীর ওপর। কিন্তু যেকোনো মুক্তবাণিজ্য ব্যবস্থার ফলে বিরাজমান ব্যবসায়ীদের কেউ লাভবান কিংবা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এটিই নিয়ম। যখন সব ব্যবসায়ী একযোগে মুক্তবাণিজ্য ব্যবস্থার পক্ষে হাত ওঠান, তখন অর্থনৈতিক তত্ত্ব বলে, প্রস্তাবিত সেই মুক্তবাণিজ্য ব্যবস্থা আলোর মুখ দেখতে পায় না।