বিজয় দিবস সামনে রেখে কলামটি লিখতে গিয়ে মনে পড়ল জহির রায়হান পরিচালিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র স্টপ জেনোসাইড-এর কথা। এটা এ কারণে নয় যে মুক্তিযুদ্ধের সময় তৈরি করা এ সিনেমায় দেখানো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় শিবিরগুলোয় শরণার্থীদের মানবেতর জীবনযাপন আর জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বকে আরও একবার স্মরণ করা। সিনেমাটির কথা বরং মনে পড়ছে সিনেমাটির একেবারে শেষের কথাগুলোর কারণে।
আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী ও মাফিয়াতন্ত্রের শাসনামলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের একটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের নানা দিককে বিতর্কিত করে তোলা। এই সময়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান যেমন ব্যবহার করা হয়েছে প্রতিপক্ষের ওপরে হামলে পড়ার মিছিলে, তেমনি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বাস্তবায়নের বয়ান সামনে আনা হয়েছে জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া ক্ষমতা ধরে রাখতে আর উন্নয়নের নামে সীমাহীন লুটপাটকে ধামাচাপা দিতে।
ফলে আমাদের ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুর মতো এগুলোর মর্যাদাহানি হয়েছে। আছে বিপরীত চিত্রও বিরোধীদের ওপরে নিপীড়নকে জায়েজ করার ‘জঙ্গি’র সঙ্গে রাজাকার শব্দটির অন্যায্য ব্যবহার শব্দটির তীব্র নেতিবাচক দ্যোতনা কমিয়ে দিয়েছে অনেকটাই।
সমস্যা আছে আরও অনেক। মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি জনযুদ্ধকে এমনকি একটি দলও না, স্রেফ একজন ব্যক্তির ইতিহাসে পরিণত করার চেষ্টা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই অস্বীকার করা হয়েছে ১৯৪৭ সালের পর ধাপে ধাপে ১৯৭১ সালে আসার পথের অনেক আন্দোলনকে। ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে আমাদের কয়েকজন ‘ফাউন্ডিং ফাদারকে’।
হলোকাস্ট ডিনায়ালের মতো আলাদা কোনো আইন না বানালেও বিগত সরকার প্রথমে ডিজিটাল এবং এরপর সাইবার নিরাপত্তা আইনে মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন বয়ানকে রীতিমতো অপরাধ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। ডিজিটাল বা সাইবার নিরাপত্তা আইনের ধারা ২১ অনুযায়ী কেউ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণা চালান বা উহাতে মদদ প্রদান’ করলে তাঁর অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
শেখ হাসিনার সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ঘটা ঘটনার প্রেক্ষাপটে তাঁর পতন এবং পালিয়ে যাওয়ার পরে তাঁর সঙ্গে একাত্তরকেও কেউ কেউ প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশে ‘সুদূর অতীতের’ একাত্তর আর ততটা প্রাসঙ্গিক নয়। বাংলাদেশ সুন্দর ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অনুপ্রেরণা ও রসদ নাকি ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার মধ্যেই পাওয়া যাবে।
দীর্ঘ ১৫ বছরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে কার্যত একটি উপনিবেশে পরিণত করেছিলেন। এই উপনিবেশ যেমন ছিল ভারতের, তেমনি ছিল মাফিয়াতন্ত্র কায়েমে তাঁর সঙ্গীদের। উপনিবেশের মতোই তাঁরা বাংলাদেশের সম্পদ লুট করে বিভিন্ন দেশে নিয়ে গেছেন। ভারতের অন্ধ সমর্থনে শেখ হাসিনা জনগণের ওপর চালিয়েছিলেন ভয়ংকরতম অত্যাচার-নিপীড়ন।
এ প্রেক্ষাপটে ১৫ বছরের নিরন্তর লড়াই এবং জুলাই-আগস্টে রীতিমতো একটা ‘প্রায় যুদ্ধের’ মাধ্যমে শেখ হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করার পর রীতিমতো স্বাধীনতার আনন্দ পেয়েছিলাম আমরা। আবেগে আপ্লুত আমরা অনেকেই সেটাকে বলেছিলাম ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’। মানি, ব্যাপ্তি ও তীব্রতায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে ২০২৪ তুলনীয় নয়, কিন্তু মানুষের সেই প্রাথমিক আবেগ মিথ্যা নয় নিশ্চয়ই। তবে তাই বলে আমাদের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ অপ্রাসঙ্গিক করে দেবে আমাদের ‘আসল স্বাধীনতাকে’!