সাল ২০১২। ঢাকা থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের শ্রমিক এলাকা। প্রতিদিনের মতো সুমাইয়া, মৌসুমী, লাভলী, দুলালী, শাহ আলম, নজরুল, রেবা, সবিতাসহ সবাই গিয়েছেন তাদের কর্মস্থলে। ৯ তলা ভবন। প্রতিষ্ঠানের নাম তাজরীন ফ্যাশন। এই ভবনেই ২৪ নভেম্বর ২০১২ সালে ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেননি অনেকে। কেউ পরে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের কি আমরা মনে রেখেছি?
তাজরীনের মালিক এবং সরকারের অবহেলায় শতাধিক শ্রমিকের প্রাণ ও স্বপ্ন ঝলসে নিশ্চিহ্ন হয় আগুনে। ত্রুটিপূর্ণ নকশা, প্রশস্ত সিঁড়ি ও অতিরিক্ত বহির্গমন পথ না থাকা, শ্রমিকদের আটকে রাখাসহ নানা অনিয়মে প্রাণ হারান তারা। প্রাণ হারানোর সংখ্যা আড়াল করার চেষ্টা চলে বরাবরের মতো। সরকার বলে মৃতের সংখ্যা প্রায় ১১২ জন। পরে প্রাপ্ত নানা তথ্য ও গবেষণা থেকে ১১৯ জনের প্রাণ হারানোর খবর নিশ্চিত করেছেন অ্যাক্টিভিস্ট, অ্যানথ্রোপলজিস্ট দলের বন্ধুরা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের জীবনে এক ভয়াবহ অবকাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের নাম। আগুনে ঝলসে যাওয়া, গলিত হয়ে যাওয়া কিংবা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়া দেহাবশেষের দৃশ্য চোখের সামনে ঘুরে ফিরে আসে। আপনজনকে নির্মমভাবে হারানো, চিনতে না পারা, ছুঁতে না পারা কিংবা বেওয়ারিশ হিসেবে সমাধি করার যন্ত্রণা কেমন, ভাবলে গা শিউরে উঠে আজও।
তাজরীন হত্যাকাণ্ড আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ২৫ মার্চ ১৯১১ সালের ঘটনার স্মৃতি; যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটনের ট্রায়াঙ্গল শার্টওয়েস্ট কারখানায় প্রাণ হারানো শ্রমিকদের কথা। সেখানেও একইভাবে কারখানার দরজা বন্ধ থাকায় আগুনে আটকে পড়ে মারা যান ১৪৬ জন শ্রমিক। যাদের বড় অংশ নারী এবং অভিবাসী। যুক্তরাষ্ট্রে এই ঘটনায় অনেক তোলপাড় হয়।
ওই সময় শ্রমিকরা আন্দোলনের ডাক দেন। ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে। ঘটনার ভয়াবহতা এবং আলোকচিত্রীদের ছবির প্রভাব পড়ে। জননিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি ও কারখানা তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। শ্রমিক নিরাপত্তায় নতুন আইন তৈরি হয়। যথারীতি ওখানেও মালিকরা জামিনে মুক্ত হন অল্প সময়ে।
তাজরীন হত্যাকাণ্ডের পর দেশ-বিদেশের লেখক, সাংবাদিক, আলোকচিত্রী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গবেষক, সংস্কৃতিকর্মী সবার নজর পড়ে বাংলাদেশের এই শ্রমিকদের দিকে। যে পশ্চিমা ভোক্তাদের প্রতিদিনের সকাল, নতুন নতুন ফাস্ট ফ্যাশনে ঝলমলে হয়, তারাও জানতে শুরু করেন তাদের পোশাকের পেছনের নিষ্ঠুর গল্প।
অথচ সেই ঘটনায় তোবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ার হোসেনসহ দোষীদের এত বছরেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। দায় কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য ফ্যাসিবাদী সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একে সরকারের উন্নয়ন নস্যাতের নাশকতা বলেও চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। বায়ারদের দায়বদ্ধতা থেকেছে উপেক্ষিত।
এত বছর ধরে তাড়া করে বেড়ায় আপনজন হারাবার যন্ত্রণা, আগুনের তাপের মধ্যে বেঁচে থাকার লড়াই, দুঃসহ স্মৃতি, ক্ষত সহযোদ্ধা-স্বজন ও বেঁচে থাকা শ্রমিকদের। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নামে সামান্য কিছু টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে পরিত্রাণ পেয়েছে মালিক ও ফ্যাসিবাদী সরকার। প্রাপ্য শাস্তির বদলে দোষী দেলোয়ার হোসেনের জেলের বাইরে ঘুরে বেড়ানো এবং মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি হওয়া ছিল অনেকটা তার পুরস্কার প্রাপ্তির মতো।
শাস্তির বদলে ফ্যাসিবাদী পতিত সরকারের সঙ্গী হয়ে থাকতে পেরেছে দোষীরা। কীভাবে অপরাধকে আড়াল করা এবং আগুনে পুড়ে মরা শ্রমিকের জীবন মূল্যহীন করা হয় তার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে ফ্যাসিবাদী সরকার। ১৫ বছরের শাসনামলে কোনো পোশাক মালিক বিচারের আওতায় যথাযথভাবে আসেনি। কেউ হয়েছে মেয়র, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য কিংবা ফ্যাসিবাদের দোসর। পেয়েছে আইনি প্রক্রিয়া থেকে পরিত্রাণ।