আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিসহ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন এবং একই সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে পারস্পরিক আদান-প্রদানের ব্যাপক আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন দেখিয়ে ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে যাত্রা শুরু করেছিল সার্ক। প্রতিষ্ঠার প্রথম দুই দশকে সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা ক্ষেত্রে কিছু বাস্তবধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করে শিল্প-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ কিছু সফল কার্যক্রম হাতে নিয়েছিল এই সংস্থা। কিন্তু পরবর্তীকালে দক্ষিণ এশীয় মুক্তবাণিজ্য এলাকা ঘোষণা এবং বাণিজ্য সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। মূল সার্কই যখন বিলুপ্তপ্রায় এবং অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, তখন এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফেডারেশন অব সার্ক রাইটার অ্যান্ড লিটারেচারের (ফোসওয়াল) উদ্যোগে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল চার দিনব্যাপী সার্ক সাহিত্য উৎসব।
সার্কভুক্ত দেশের কবি, লেখক, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও বুদ্ধিজীবীদের একমাত্র আঞ্চলিক সংস্থাটি যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৮৬ সালে। বর্তমানে আঞ্চলিক সংস্থাটির কার্যকরিতা না থাকলেও সৃজনশীল লেখক-কবিদের নিয়ে বছরে দুইবার আয়োজিত এই সম্মেলনে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ৬৫তম উৎসবটিতে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভারতের শতাধিক কবি, লেখক ও সাহিত্য সমালোচক অংশ নিয়েছেন। সংস্থাটির প্রাণ প্রতিমা খ্যাতিমান লেখক, পথিকৃৎ সাংস্কৃতিক সংগঠক পদ্মশ্রী অজিত কৌর কয়েক দশক আগে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর সৃজনশীল মানুষদের বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে শান্তি ও প্রগতির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা থেকে এই নিয়মিত উদ্যোগ। শিল্প-সাহিত্যের পাশাপাশি সংস্থাটি লোকসংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য এবং সুফিবাদ ও বুদ্ধের সৌহার্দ্য এবং সহনশীলতার মর্মবাণী তুলে ধরার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
‘প্রকৃতি ও পরিবেশ ভাবনা’ ছিল এ বছরের সাহিত্য উৎসবের মূল থিম। উৎসবের প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট পরিবেশবাদী পদ্মশ্রী সন্ত বলবীর সিং সিচেওয়াল, যিনি পাঞ্জাবে একাধিক নদী সংস্কার, বৃক্ষরোপণ ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা বিস্তারের জন্য আজীবন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংস্থার চেয়ারম্যান পদ্মশ্রী অজিত কৌর। প্রথম দিকের উৎসবগুলোতে সার্কভুক্ত সব দেশের লেখক এবং কবি অংশগ্রহণ করলেও রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের যোগদান বন্ধ হয়ে যায়।
তবে আফগানিস্তান এই উৎসবে যোগ দেওয়ায় অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা সাতই থেকে যায়। আফগানিস্তানে তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠার পরে সে দেশের লেখক-বুদ্ধিজীবীরাও এই উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ২৫ থেকে ৩০ জন এতে যোগ দিলেও ভিসা সম্পর্কিত জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে এবার অংশ নিয়েছেন মাত্র চারজন।
উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ৩৮ বছরে ভারতের বিভিন্ন শহরে ছাড়াও নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং একবার পাকিস্তানেও এই উৎসব আয়োজিত হয়েছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বর্তমানে সার্ক নিজেই যখন স্তিমিত, তখন ফেডারেশন অব সার্ক রাইটার অ্যান্ড লিটারেচারের মতো একটি বেসরকারি উদ্যোগের এই সাহিত্য সম্মেলন টিকে আছে কেবল এর প্রতিষ্ঠাতা পদ্মশ্রী অজিত কৌর এবং তার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কন্যা অর্পনা কৌরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আর্থিক সহযোগিতার ফলে।
সার্ক সাহিত্য উৎসবের শুরু থেকেই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কবি ও লেখকদের উপস্থিতি ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। শামসুর রাহমান, সেলিনা হোসেন, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, মফিদুল হক, রামেন্দু মজুমদার, ফখরুল আলমসহ বিপুলসংখ্যক লেখক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, কবি ও সাংস্কৃতিক সংগঠককে সার্ক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। এ বছর সার্ক সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছেন ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম ও কবি বিমল গুহ। বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের কয়েকজন কবি ও লেখককে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় নিষ্প্রভ হলেও সাহিত্য উৎসবে সার্কভুক্ত দেশের কবি-সাহিত্যিকরা লেখালেখির বাইরে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন। ভিন্ন ভাষাভাষী পাঁচটি দেশের কাব্যকথার মানুষজন পাঁচ দিন ধরে দিনরাতের বেশির ভাগ সময় একসঙ্গে থেকেছেন, আবৃত্তি-পাঠ ও সাংস্কৃতিক আয়োজন উপভোগ করেছেন।
একই ধরনের সাংস্কৃতিক ইতিহাস-ঐতিহ্য, লোকাচার ও লোকসংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য, জীবনাচরণ ও ভাষাগোষ্ঠীর ঐক্য দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যে মানবগোষ্ঠীর বসবাস, তাদের ভেতরে এক ধরনের গভীর মানবিক যোগসূত্র স্থাপন ছিল এই সাহিত্য সম্মেলনের উদ্দেশ্য। সমাজের প্রাগ্রসর মানুষ, শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও যোগাযোগের সূত্রে শুধু ভাবের আদান-প্রদান বা অভিজ্ঞতা বিনিময় নয়, সব ধরনের বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে শান্তি ও সহমর্মিতার আকাঙ্ক্ষাই হয়ে ওঠে সব উৎসবের মূল সুর। বিগত প্রায় চার দশকে ফোসওয়াল সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ৬৫টি সম্মেলন অনুষ্ঠান ছাড়াও দক্ষিণ এশীয় কথাসাহিত্যিক ও কবিদের লেখা অনুবাদ করে অর্ধশতাধিক অত্যন্ত মানসম্পন্ন গ্রন্থ প্রকাশ করেছে।