মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ; সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ—অবকাঠামো খাতের তিন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। সরকারের ১০০ দিনের অর্জন ও ব্যর্থতা এবং বিদু্যৎ, জ্বালানি, সড়ক, রেলের সংস্কার ও উদ্যোগ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।
ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ১০০ দিন পার হলো। সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে, এমন এক বাস্তবতায় আপনারা দায়িত্ব নিয়েছেন, আপনাদের সামনে চ্যালেঞ্জটা বিশাল। মোটাদাগে সরকারের অর্জনকে কীভাবে দেখছেন?
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: বাংলাদেশটা শুধু লাইনচ্যুত হয়ে গিয়েছিল তা নয়, অন্যদিকেও চলে গিয়েছিল। আমাদের দায়িত্বটা বাংলাদেশকে লাইনে তোলা। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বিরাট একটা সমস্যা ছিল। এখন সেটা স্থিতিশীল অবস্থায় এসেছে। আগের সরকার অনেক বেশি টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছেড়েছে। একদিকে পণ্যের পরিমাণ কম, অন্যদিকে বাজারে অনেক বেশি টাকা। ফলে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। আমরা এসে টাকা ছাপানোটা বন্ধ করেছি। এটা সরকারের আরেকটি বড় অর্জন।
হাসিনা সরকার বিরাট একটা দেনার বোঝা দেশের ঘাড়ে রেখে গেছে। জ্বালানি তেল, এলএনজি, দেশ ও বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ কেনার বিশাল দেনা। এই দেনাটা ডলারেও আছে, টাকাতেও আছে। ধীরে ধীরে আমরা এই দেনা পরিশোধ করছি। দেনা যখন অনেক বেশি বকেয়া হয়ে যায়, তখন যাঁরা সেবা প্রদান করেন, তাঁরা তো অস্থির হয়ে যান। আমরা সেই দেনাগুলো ধীরে ধীরে পরিশোধ করছি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা সফলও হয়েছি। যেমন বিপিসির দেনা আমরা পুরোপুরি শোধ করেছি।
ডলারের দেনাটাও আমরা অনেকখানি কমিয়ে আনতে পেরেছি। আমরা যখন দায়িত্ব নিই, তখন ডলারে দেনা ছিল প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার। এখন সেটা কমিয়ে দেড় বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নিয়ে এসেছি। আমাদের সব দেনা শেষ পর্যন্ত টাকার দেনা। কারণ, ডলারও কিন্তু টাকা দিয়ে কিনতে হয়। ফলে দেনা মেটাতে হলে প্রথমে টাকার সংস্থান করতে হবে, ডলারের সংস্থান করতে হবে। এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকে রেমিট্যান্স বাড়ছে। এর ফলে সেখান থেকে ডলার পাওয়া যাচ্ছে। রিজার্ভ ভেঙে ডলারের জোগান দিতে হচ্ছে না। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারের অনেক অপচয় বন্ধ হয়েছে। সেই টাকা দিয়ে আমরা দেনা পরিশোধ করছি।
আমরা সংকোচনমূলক একটা মুদ্রানীতি নিয়েছি। এ ধরনের মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনে কিন্তু তার জন্য একটা সময় লাগে। সার্বিকভাবে আমরা মনে করি, অর্থনীতি একটা শকের মধ্যে ছিল, সেই শকটা আমরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। অর্থনীতির লাইনচ্যুত ট্রেনটাকে আমরা লাইনে তুলতে পেরেছি।
১০০ দিন মানে, আমরা ধরে নিতে পারি সরকারের হানিমুনকালটা শেষ হয়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি—এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। মানুষ তো চায় দৃশ্যমান পরিবর্তন। এই ব্যর্থতার ব্যাপারে কী বলবেন?
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে না পারা। হাজারের বেশি ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে, ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে আহত করা হয়েছে। সেটা তো মূলত পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করেছে। ফলে নৈতিকভাবে তারা খুব ভেঙে পড়েছে। তাদের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে। পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মর্যাদার পুলিশের সাবেক আইজি খোদাবকশ চৌধুরীকে নিয়েছি। আমরা আশা করছি, তিনি পুলিশকে পুনর্গঠন করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হবে।
আমাদের দ্বিতীয় বড় ব্যর্থতা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমরা সারের সরবরাহ যাতে অব্যাহত থাকে, সেই উদ্যোগ নিয়েছি। সামনের সেচ মৌসুমের জন্য জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করছি। খাদ্যের সরবরাহ যাতে বাড়ে, সে জন্য আমদানির পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা আশা করছি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশাটা অনেক বেশি। আমাদের কাছে তো জাদুর চেরাগ নেই যে রাতারাতি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমরা যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছি, সেগুলো ধীরে ধীরে কাজ করতে শুরু করেছে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা ফল বয়ে নিয়ে আসে না। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। বর্তমান মূল্যস্ফীতিটা টাকা ছাপানোর কারণে হচ্ছে না। সেটা হচ্ছে সরবরাহ ঘাটতির কারণে। আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসে পরপর দুটি বড় বন্যা হয়েছে। ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালীর মতো যেসব জায়গায় বন্যা হয় না, সেখানেও বন্যা হয়েছে। এ জায়গাগুলো সবজি উৎপাদনের জায়গা। ফলে একটা সরবরাহ-ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
সরকারের মধ্যে সমন্বয় কতটা, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। অগ্রাধিকারের জায়গা কোনটা হওয়া দরকার, তা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন। নতুন উপদেষ্টা যুক্ত এবং দায়িত্ব রদবদল হলো। একটা বড় লক্ষ্য সামনে রেখে কতটা টিম হয়ে উঠতে পারলেন উপদেষ্টারা।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: ৮ আগস্ট প্রথম অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে উপদেষ্টারা প্রথম শপথ নিলেন। এরপর ১৬ আগস্ট আমরা আরও চারজন যুক্ত হলাম। ১১ নভেম্বর আরও কয়েকজন যুক্ত হলেন। প্রথম দুই ব্যাচে যাঁরা উপদেষ্টা পরিষদে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একটা সমন্বয় গড়ে উঠছে। নতুন যাঁরা এসেছেন, তাঁদের আরও সময় লাগবে। উপদেষ্টা পরিষদে বিভিন্নজন বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন। আমরা কয়েকজন সরকারে কাজ করে এসেছি, কয়েকজন এনজিওতে কাজ করে এসেছেন, কয়েকজন ছাত্র উপদেষ্টা আছেন। আমরা এখন পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা করছি। ফলে ধীরে ধীরে আমাদের সমন্বয়টা গড়ে উঠছে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া।
অনেকে মনে করেন, শেখ হাসিনা সরকারের জ্বালানির ভুল নীতি আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও স্থবিরতার জন্য প্রধানভাবে দায়ী। একদিকে চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, দায়মুক্তি আইন, অন্যদিকে আমদানিনির্ভরতা ও ভারতনির্ভরতা। আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে, সেটা কি সংকট উত্তরণে যথেষ্ট?
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: বিগত কয়েক বছর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দুর্নীতির মহোৎসব হয়েছে। এর ভিত্তিটা ছিল ২০১০ সালের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটা। আইনে যেমন দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, আবার এটা ছিল প্রতিযোগিতাবিরোধী আইন। জরুরি আইন হিসেবে পাস হলেও ২০২৬ সাল পর্যন্ত আইনটা বলবৎ ছিল। আমরা এসে আইনটা বাতিল করেছি। আমরা বলেছি, এখন থেকে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত নীতিমালা আমরা অনুসরণ করব। প্রতিযোগিতা ছাড়া কোনো কাজ কেউ পাবে না।