আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনে ভাসানী এখনো প্রাসঙ্গিক

কালের কণ্ঠ গাজীউল হাসান খান প্রকাশিত: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০৪

সামন্তবাদী কিংবা পুঁজিবাদী, আধিপত্যবাদী কিংবা উপনিবেশবাদী—যেখানেই যেকোনো ধরনের অপশাসন ও শোষণ দেখেছেন, সেখানেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে গর্জে উঠেছেন আজন্ম সংগ্রামী মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। খোলা তরবারির মতো ঝলসে উঠেছে তাঁর দুটি হাত। কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে বিদ্রোহের হুংকার। কৈশোর থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত তাঁর দীর্ঘ ৯৬ বছরের জীবনটি ছিল সংগ্রামের একটি পরিপূর্ণ ইতিহাস।

তিনি যেমন দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের হয়ে জমিদার, মহাজন ও শিল্পপতিদের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তেমনি পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সার্বিক সংগ্রামে ছিলেন আপসহীন। তাঁর দীর্ঘ জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কেটেছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসকদের কারাগারে। তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জে ১৮৮০ সালে জন্মগ্রহণ এবং ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর টাঙ্গাইলের সন্তোষে মৃত্যুবরণ করেন এই অগ্নিপুরুষ। এর মধ্যে আড়াই দশকের মতো তিনি ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলে কাটিয়েছেন।

শৈশবে মা-বাবাকে হারিয়ে ভাসানীর শুরু হয়েছিল নিজের অস্তিত্ব রক্ষার এক নিদারুণ সংগ্রাম। শৈশবে একসময় তিনি সিরাজগঞ্জ বাজারে মুটে-মজুরের কাজ করে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। এবং রাতে তাঁর আশ্রয় হতো যমুনার বুকে নোঙর করা সওদাগরি নৌকায় নতুবা দোকানের খোলা বারান্দায়। অথচ সেদিনের সেই কিশোরটির জন্ম হয়েছিল এক অবস্থাপন্ন গ্রামীণ পরিবারে।

পিতৃ-মাতৃহীন কৈশোর থেকেই শোষণ-শাসন ও বঞ্চনার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল ভাসানীর। তিনি সমাজের পদে পদে প্রত্যক্ষ করেছেন কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি জনতার ওপর অন্যায় শোষণ-শাসন ও জুলুম-নির্যাতনের চিত্র, যা তাঁকে ক্রমে প্রতিবাদী এবং এক পর্যায়ে বিদ্রোহী করে তোলে।


সে অবস্থায় বেড়ে ওঠার মধ্যেও তরুণ ভাসানী বিভিন্ন সময় ও সুযোগমতো কিছু ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তিনি এক পর্যায়ে ময়মনসিংহের একটি মাদরাসা থেকে টাঙ্গাইলের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় ফিরে আসেন। বলতে গেলে সেই থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু হয়েছিল ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন।




এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১৯ সালে ভাসানী ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ এবং খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে তিনি সে সময়ে বিরাজমান মহামন্দা ও দুর্ভিক্ষকালীন অসহায় কৃষককুলের পাশে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সে অবস্থায় তাঁর এক বিবাদ শুরু হয়েছিল সন্তোষের তৎকালীন মহারাজার সঙ্গে, যা শেষ পর্যন্ত তাঁকে টাঙ্গাইল ছাড়তে বাধ্য করেছিল। সংগ্রামী ভাসানী ১৯৩০ সালের শেষের দিকে টাঙ্গাইল থেকে আসামের ঘাগমারায় নিজেকে স্থানান্তর করেছিলেন। সেখানে তিনি ছিন্নমূল বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের স্বার্থের পক্ষে আন্দোলন জোরদার করে তোলেন। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ভাসান চরে কৃষকদের বন্যা থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি বাঁধ নির্মাণ করেন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। সেই থেকে আবদুল হামিদ খানের নাম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘ভাসানীর মওলানা’ হিসেবে। কৃষক ও শ্রমিক কুলের বেশির ভাগ মানুষ তাঁর প্রকৃত বা আসল নামটি জানতই না। সবাই চিনত মওলানা ভাসানী নামে। সে সময় আসাম সরকার বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের বিস্তার রোধ করার জন্য ভৌগোলিকভাবে একটি ‘লাইনপ্রথা’ চালু করে। এতে বাঙালি বসতি স্থাপনকারী, বিশেষ করে ভূমিহীন কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের সমূহ ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। সে প্রথার বিরুদ্ধে বাঙালি কৃষকসমাজকে সংঘবদ্ধ করে ভাসানী একটি আন্দোলন গড়ে তোলেন। সে আন্দোলনই মওলানা ভাসানীকে প্রকৃত অর্থে সমগ্র ভারতবর্ষ এবং আন্তর্জাতিকভাবে একজন কৃষক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। লাইনপ্রথা আন্দোলনই ভাসানীকে সব দিক থেকে ভাসানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এ মন্তব্য করেছিলেন বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক প্রয়াত সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি ভাসানীর ওপর লিখিত তাঁর একটি তথ্যবহুল ও মূল্যবান গ্রন্থে সে কথা উল্লেখ করেছেন।


মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৩৭ সালে আসাম মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এতে নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে ভাসানীর সাংগঠনিক শক্তি ও মর্যাদা অনেক বেড়ে যায়। এবং আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী স্যার মোহাম্মদ সাদ উল্লাহ ও অন্যান্য স্থানীয় নেতার সঙ্গে তখন ভাসানী ও তাঁর বাঙালি কৃষক অনুসারীদের এক বিরাট দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল। ভাসানী তখন আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় অবস্থান নিয়েছিলেন। ভাসানীকে তখন চক্রান্তমূলকভাবে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৯৪৭ সালে আসাম থেকে চিরস্থায়ীভাবে চলে যাওয়ার শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জঙ্গল ও ঝোপঝাড় কেটে আবাদ করা আসামের ওপর মওলানা ভাসানী কখনো বাঙালি কৃষককুল ও শ্রমিক শ্রেণির অধিকারের বিষয়টি ভুলে যাননি কিংবা রাজনীতিগতভাবে তাদের দাবির প্রশ্নে আপস করেননি। সে কারণে মৃত্যুর আগেও তিনি আসামের বেশ কিছু অঞ্চল (করিমগঞ্জসহ) বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করার কথা বারবার বলে গেছেন। আসাম, পূর্ব বাংলা, ত্রিপুরা রাজ্যসহ বেশ কিছু অবিচ্ছেদ্য অঞ্চল নিয়ে তিনি বৃহত্তর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। এ ক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলার কথাও তিনি দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, পশ্চিম বাংলা, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যকে প্রস্তাবিত বৃহত্তর বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা একটি সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের অংশ। পশ্চিম বাংলার শরৎ বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম, মওলানা ভাসানীসহ অনেকে তখন ভারত বা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে অখণ্ড স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য রীতিমতো আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতদ্বৈতের কারণে শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে বিফল মনোরথ হয়ে ১৯৪৮ সালের সূচনায় ভাসানী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। এবং তাঁর অতীত সংগ্রামের বিচরণক্ষেত্র টাঙ্গাইলে ফিরে এসে তিনি পর পর কয়েকটি কৃষক সমাবেশের আয়োজন করেন। স্থানীয় কৃষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ভাসানী তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। সে সময় তিনি একটি উপনির্বাচনে টাঙ্গাইলের করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাফল্য লাভ করেও কেন্দ্রের মুসলিম লীগ নেতৃত্বের কূটচালে তা হারিয়ে ফেলেন। সেসব কারণে অতি অল্প সময়ের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানি, বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের আধিপত্য বিস্তার ও শোষণ-শাসনের অপকৌশল দেখে ভাসানী মুসলিম লীগের ওপর আস্থা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেন।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us