২০০৪ সালে আওয়ামী লীগ বিএনপি সরকারের উদ্দেশে একটি ট্রাম্প কার্ড বা তুরুপের তাস দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল বলেছিলেন, ৩০ মের পর বিএনপি আর ক্ষমতায় থাকবে না। খালেদা জিয়া প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাবেন।
সে সময় রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন ছিল, বিএনপি থেকে ১০০ এমপিকে বিরোধী দলে নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টা সফল হয়নি, বিএনপি মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এক দলের টিকিটে নির্বাচিত হয়ে অন্য দলে গেলে তাঁর এমপি পদ থাকে না। তারপরও বাংলাদেশে এমপি কেনাবেচার উদাহরণ কম নয়। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে বিএনপির দুজন এমপিকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছিল। আইনি লড়াইয়ে তাঁরা হেরে যান এবং সদস্যপদ হারান।
এবার ক্ষমতা হারিয়ে আওয়ামী লীগ ভিন্ন ধরনের ট্রাম্প কার্ড দিয়েছে দেশবাসীকে। দেশের রাজনীতিতে বিদেশি ট্রাম্পকে নিয়ে আসা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পেই নাকি ভরসা করছেন তারা।
১০ নভেম্বরকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে নূর হোসেন চত্বরে সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছিল। সেটি তারা দিতেই পারেন। যুবলীগের কর্মী নূর হোসেন ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন। পুলিশ তাঁকে সরে যেতে বললেও তিনি শোনেননি। এরপর পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন হলে তিনি হয়ে ওঠেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক। এবারে যেমন ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে প্রতীক হয়েছিলেন রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ।
কয়েক দিন আগে শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া একটি অডিও ক্লিপে বলতে শোনা যায়, সমাবেশে তিনি নিজের ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি দিয়ে বানানো ফেস্টুন রাখতে বলেছেন। সেখানে হামলা হলে সেই ছবি তোলার জন্য আগে থেকেই ক্যামেরাম্যান ঠিক করে রাখতে হবে। এরপর হামলার ছবি আমেরিকায় পাঠিয়ে বলা হবে, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে’।
এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে ঢাকার বাইরে থেকে নেতা-কর্মীদের রাজধানীতে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কেউ আসেননি। তবে সরকারের কড়া পাহারা ছিল ঢাকার প্রবেশ পথে।
যেই দলটি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং নিজেকে প্রকৃত জাতীয়তাবাদী বলে দাবি করে, সেই দল রাজনৈতিকভাবে কতটা দেউলিয়া হলে নূর হোসেন দিবস পালনের জন্য ট্রাম্পের ছবি ব্যবহার করতে বলতে পারে! আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী যদি ধরেও নিই, শেখ হাসিনার কথোপকথনটি বানানো, তাহলে প্রশ্ন আসবে দলের নেতা-কর্মীরা ট্রাম্পের পোস্টার-সংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে কেন রাস্তায় নামলেন? কথোপকথনটি সত্য হোক বা বানানো হোক, দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা বিশ্বাস করছেন এবং ট্রাম্পের ছবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন।
গত তিন মাসে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে অনেক বার্তা ও বিবৃতি এসেছে। কিন্তু তাঁরা কোনোটিতে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে যে দেড় হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হলো, তাঁদের জন্য কোনো শোক প্রকাশ করেননি। নিহতদের পরিবার ও আহতদের প্রতি সমবেদনা জানাননি। তারা এটিকে বরাবরের মতো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেছেন এবং এখনো দেখছেন। কিন্তু ‘বীরের এ রক্তস্রোত ও মায়ের এ অশ্রুধারা’ যে এখনো শুকায়নি, সেটা আওয়ামী লীগের অতি বিজ্ঞ নেতারা উপলব্ধি করতে পারছেন না।