দীর্ঘদিন দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে যে ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করেছে, তাতে সহসা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয়নি। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বহু বছর ধরে ধীরে ধীরে জমতে জমতে আজ বিশাল এক সমস্যাসংকুল মহিরুহে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্ত করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে না পারলে আগামী দিনগুলোয় আমাদের জন্য ভয়ানক পরিণতি অপেক্ষা করছে, তাতে সন্দেহ নেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে শিক্ষা নিয়ে যেসব চ্যালেঞ্জ বিরাজ করছে, সেগুলোর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি অন্যতম, যা মোকাবিলা করা জরুরি। শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির কারণে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থা একরকম ভেঙে পড়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সেটি কীভাবে? শিক্ষা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন এমন সচেতন মানুষমাত্রই দেখবেন, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। কোথাও কোথাও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার অর্ধেকেরও কম। আবার কোনো কোনো শ্রেণিতে হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। এর কারণ কী?
স্কুলগুলোয় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি হ্রাসের পেছনের কারণ অনুসন্ধান করার জন্য খুব বড় মাপের গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেই প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করা সম্ভব। নমুনা হিসাবে এখানে একটি জরিপের ফলাফল উল্লেখ করা প্রয়োজন। কয়েক বছর আগে প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গড় উপস্থিতির হার ৪৮.১ শতাংশ। অর্থাৎ ৫১.৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই স্কুলে অনুপস্থিত থাকছে (তথ্যসূত্র : মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯, ইউনিসেফ, বাংলাদেশ ও বিবিএস)। এ চিত্র থেকেই বোঝা যায় বাস্তবে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার কতটা নিম্নগামী!
অন্যদিকে স্কুল-শিক্ষার্থীদের বহু অভিভাবকের অভিযোগ, স্কুলে নিয়মিত ক্লাস হয় না। স্কুলগুলোয় যদি নিয়মিত ক্লাস না হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আবার কখনো কখনো দেখা যায়, বহু শিক্ষক নির্ধারিত সময়ের পর শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেন। এরপর পাঠদানের জন্য যে সময়টুকু অবশিষ্ট থাকে, সে সময়ে আর বিষয়বস্তু নিয়ে কার্যকর পাঠদান করা হয়ে ওঠে না। এটি এক ধরনের ফাঁকি দেওয়া বোঝায়। শিক্ষার্থীরা স্কুল পর্যায়ের হলেও তারা যে পাঠদানে শিক্ষকের এ ধরনের ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা ধরতে পারে না, তা নয়। পার্থক্য হলো, শিক্ষার্থীরা সেটি সরাসরি প্রকাশ করে না। আমরা বিশ্বাস করি, এ ধরনের শিক্ষকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। কিন্তু সংখ্যায় অল্প হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি ও নেতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি।
আবার কোনো শ্রেণিতে যদি পাঠদানের সময়সূচি অনুযায়ী নির্ধারিত বিষয়ের ক্লাস ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত না হয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের আর শ্রেণিকক্ষে ধরে রাখা যায় না। তারা স্কুল ত্যাগ করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে অনেকেই স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে শ্রেণিকক্ষ ত্যাগ করে। আমি নিজে অনেকবার একাধিক সরকারি স্কুলে দেখেছি, স্কুল চলাকালে যেসব শ্রেণিতে ক্লাস হচ্ছে না, সেসব শ্রেণির শিক্ষার্থী স্কুলব্যাগ হাতে নিয়ে শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও তাদের স্কুলের সীমানা প্রাচীর টপকিয়ে চলে যেতেও দেখা গেছে। বহুবার এ দৃশ্য দেখে বিস্মিত হয়েছি। শিক্ষার্থীরা নিজেদের ইচ্ছামতো স্কুল থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তাহলে স্কুল কর্তৃপক্ষ করছে কী? আমাদের বুঝতে হবে, এ ধরনের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তির ফলে শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে স্কুলবিমুখ হয়ে পড়ে। এটাকে স্কুল পালানো বলে না। বরং স্কুলের প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে এমনটি ঘটে বলে মনে করি। স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি হ্রাসের পেছনে নিয়মিত ক্লাস না হওয়া অন্যতম কারণ।
শিক্ষার্থীদের স্কুলে না আসার পেছনে আরও কারণ রয়েছে। এর একটি হলো, শিক্ষার্থীদের অতিমাত্রায় কোচিংনির্ভরতা। এখানে বোধকরি বলা ভালো, কোচিংয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের চেয়ে তাদের অভিভাবকদের আগ্রহ ও আকর্ষণ অনেক বেশি। পড়ালেখার মাধ্যমে নিজ সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে অনেক অভিভাবক কোচিং করানো নিয়ে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। এমন বহু শিক্ষার্র্থী আছে, যারা নিজেরা যথেষ্ট মেধাবী। এ ধরনের শিক্ষার্থীদের শুধু স্কুলের শ্রেণিকক্ষে বিষয় সম্পর্কিত দুর্বোধ্য বিষয়বস্তুর ওপর কিছু নির্দেশনা দিলেই তারা বাকিটুকু বুঝে নিতে পারে। তবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলের সময়ের বাইরেও কিছুটা বাড়তি সময় দিয়ে পড়ালেখার বিষয়বস্তু বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। স্কুলশিক্ষকরা এ ধরনের শিক্ষার্থীদের বাড়তি সময় দিতে পারলে অনেক ভালো হতো। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, দুর্বল শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে বাড়তি সময়ের কোনো সুযোগ-সুবিধা পায় না। আর নানা কারণে স্কুলশিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পেছনে বাড়তি সময় দিতে চান না। ফলে শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ের দিকে ধাবিত হয়।
উদ্বেগের বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা তাদের অভিভাবকদের চাপে পড়ে কোচিং করতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ কোচিং করানো নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চলে এক ধরনের মানসিক নির্যাতন। অথচ ২০১২ সালে এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের বেলায় প্রতিবারই বিগত সরকার বেশ জোরেশোরে বলেছে, এ কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের কোচিং করানো থেকে বিরত রাখতে পারবে। বাস্তবে আমরা এ ধরনের বক্তব্যের কোনো প্রতিফলন দেখি না। বরং প্রতিনিয়তই কোচিং সেন্টারের বিকাশ ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এখনো দেশে বহু শিক্ষার্থীর সকাল শুরু হয় কোচিং সেন্টারে যাওয়ার প্রস্তুতি দিয়ে। কোচিং করার ফাঁকে যদি স্কুলে যাওয়ার সুযোগ ঘটে, তাহলে তারা স্কুলে যায়। আর কোচিং সেন্টারে একাধিক বিষয়ের কোচিং করতে গিয়ে যদি সুযোগ না পাওয়া যায়, তাহলে তাদের আর ওইদিন স্কুলে যাওয়া হয় না। নিজ সন্তানকে কোচিংয়ে পাঠানোর ব্যাপারে বহু অভিভাবক যতটা প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন এবং যতটা উদগ্রীব থাকেন, স্কুলে পাঠানোর ক্ষেত্রে তারা থাকেন ঠিক ততটাই নিষ্ক্রিয় ও উদাসীন। দেখা যায়, প্রতিটি কোচিং সেন্টার যেন হয়ে উঠছে একেকটি মিনি স্কুল! যে স্কুলের কাছে আসল স্কুলের গুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্তি দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের দেশে শুধু কারিকুলাম আধুনিকায়ন কিংবা সংস্কার করে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যাবে না। এজন্য দরকার পর্যাপ্ত মনিটরিং।