৭ নভেম্বর আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। বলা যায়, এই দিন রাজনীতির গতিধারাই বদলে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর ৭ নভেম্বরের পূর্ববর্তী সময়ে দেশের শাসনব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল। একদিকে রক্ষীবাহিনীর দমন–পীড়ন, আরেক দিকে জাসদের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নামে সশস্ত্র কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
অর্থনৈতিক অবস্থাও ছিল শোচনীয়। ’৭৪ দুর্ভিক্ষ সাধারণ মানুষকে চরমভাবে ক্ষুব্ধ করেছিল। কারণ, দুর্ভিক্ষের বিপরীতে শাসকগোষ্ঠীর কর্তৃত্ববাদী আচরণ ও বিলাসী জীবনযাপন সাধারণ মানুষ পরিষ্কারভাবেই অনুভব করেছিল। সবকিছু মিলিয়ে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যাত্রা করেছিল দেশ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনিশ্চয়তা আরও ঘনীভূত হয়। ওই সময় রাষ্ট্র পরিচালনায় ছিল না কারও একক কর্তৃত্ব। ফলে সৃষ্টি হচ্ছিল নানা ধরনের সংকট। এরই ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ও ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি সামনে চলে আসে। শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন অবসানের পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে দূর করে একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে নিয়ে গিয়েছিল ৭ নভেম্বর।
মূলত ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দুই পক্ষের একটি লড়াই লক্ষ করা যায়। প্রথমে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে তিনি গৃহবন্দী করেন। বঙ্গভবনে গিয়ে গ্রহণ করেন সেনাপ্রধানের দায়িত্ব। এরপর জাসদের কর্নেল তাহের খালেদ মোশাররফকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন সিপাহি বিপ্লবের মাধ্যমে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিয়াউর রহমানকে বন্দীদশা থেকে উদ্ধার করে সিপাহিরা ক্ষমতার মসনদে বসিয়ে দেন। জিয়াউর রহমান পরবর্তী সময় রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশ পরিচালনা করেন।
এ ঘটনাবলির শুরুতে জিয়াউর রহমান ছিলেন কার্যত আটক ও চাকরি হারানো এক জেনারেল। কিন্তু জনপ্রিয়। তাঁর এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখলেন কর্নেল তাহের। তিনিও পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু বিপ্লবের মাঠে নেমে দেখলেন, তিনিও খালেদ মোশাররফের মতোই জনভিত্তিহীন এক চরিত্র
৩ থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল তাহের ওই সময়ের পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারেননি। তাঁদের হিসাবে বড় ধরনের গরমিল ছিল। এমনকি সামরিক বাহিনীর ভেতরে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা নিয়ে তাঁদের সামান্যতম ধারণাও ছিল না। খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেও পুরো সামরিক বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারেননি।
অনেক ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারাই নীরব ছিলেন বা প্রকাশ্যে খালেদ মোশাররফের সমর্থনে অবস্থান নেননি। সামরিক বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য খালেদ মোশাররফের পক্ষে থাকলে কর্নেল তাহেরের পাল্টা অভ্যুত্থানে তাঁকে পালিয়ে যেতে হতো না। তিনি বরং প্রতিরোধ করতে পারতেন। এ ছাড়া সারা দেশেও খালেদ মোশাররফের সমর্থন ছিল না। অনেকেই মনে করতেন, বাকশালের শাসনব্যবস্থা তিনি ফিরিয়ে আনতে পারেন। ভারতের সঙ্গে তাঁর সখ্য রয়েছে।
মূলত এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে কর্নেল তাহের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য পাল্টা অভ্যুত্থানের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু কর্নেল তাহেরেরও খালেদ মোশাররফের মতো সামরিক বাহিনী ও জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না। কর্নেল তাহের মূলত জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতাকে নিজের অধীন আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি জিয়াউর রহমানের নিয়ন্ত্রণ চলে যায়। খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল তাহের আড়ালে চলে যান এবং খালেদ মোশাররফ নিহত হন।