বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ একটি বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখছে, যে সমাজে অসাম্য, শোষণ এবং বহির্ভুক্তি থাকবে না। এমন একটি সমাজ বিনির্মাণের জন্য এ দেশের উন্নয়নকে অন্তর্ভুক্তিকর হতেই হবে। অন্তর্ভুক্তিকর উন্নয়নের তিনটি বৈশিষ্ট্য গুরুত্বপূর্ণ। এক. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বজায়যোগ্য এবং দরিদ্রবান্ধব হতে হবে। দুই. এ উন্নয়নে সাম্য ও সমতা অবশ্যই থাকতে হবে। তিন. অন্তর্ভুক্তিকর উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণ এবং স্বত্ব থাকতে হবে।
প্রবৃদ্ধিকে বজায়যোগ্য ও দারিদ্র্য অভিমুখী করতে হলে প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রক্রিয়ায় দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্তকরণ এবং অর্জিত প্রবৃদ্ধির সিংহভাগ সুফলভোগ সে জনগোষ্ঠীর জন্য নিশ্চিত করতে হবে। অন্তর্ভুক্তিকর উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাম্যের মানে হচ্ছে সম্পদ, মৌলিক সামাজিক সেবা লভ্যতায় সাম্য, আয়ের পুনর্বণ্টন। সেই সঙ্গে আইনের চোখে, অধিকারের ক্ষেত্রে এবং সুযোগের ক্ষেত্রে সমতা। অংশগ্রহণের অর্থ হচ্ছে যেসব প্রক্রিয়া এবং সিদ্ধান্ত মানুষের যাপিত জীবনকে প্রভাবিত করে, তাঁরা সেসব প্রক্রিয়া ও সিদ্ধান্তে তাঁদের কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা প্রয়োগ করবে। স্বত্ব মানে হচ্ছে উন্নয়নপ্রক্রিয়া এবং ফলাফলে জনগণের মালিকানা থাকবে।
অন্তর্ভুক্তিকর উন্নয়ন অর্জন করার জন্য গ্রহণীয় নীতিমালা এবং ব্যবস্থাগুলোকে লক্ষ্যভিত্তিক, বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য হতে হবে। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতিমালাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া থাকা প্রয়োজন। নীতিমালা প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে সেসব ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিকর উন্নয়ন অর্জনের লক্ষ্যে সে উন্নয়নের উপরোল্লেখিত মাত্রিকতা ত্রয়ের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত নীতিমালাগুলো এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
অন্তর্ভুক্তিকর উন্নয়নের প্রথম স্তম্ভ হচ্ছে বজায়যোগ্য এবং দরিদ্রবান্ধব প্রবৃদ্ধি। এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের সামগ্রিক ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে।
প্রথমত. বজায়যোগ্য প্রবৃদ্ধি প্রসারণের জন্য একটি সামষ্টিক কাঠামো এবং দ্বিতীয়ত. অর্জিত প্রবৃদ্ধিকে দরিদ্রবান্ধব করা। বজায়যোগ্য প্রবৃদ্ধির জন্য সামষ্টিক নীতিমালা তিনটা বিষয়ের ওপরে জোর দিতে পারে।
এক. রাজস্বনীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো তৈরিতে সরকারি বিনিয়োগের প্রসারণ এবং শিল্প, রপ্তানি ও কৃষি-সম্পৃক্ত কর্মকাণ্ডের মতো উচ্চ উৎপাদনশীল খাতগুলোকে মুদ্রানীতির মাধ্যমে ঋণ প্রদান।
দুই. সেই সব খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা, যেগুলো একদিকে দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি বাড়াবে এবং সেই সঙ্গে মর্যাদামূলক প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ কমিয়ে দেবে।
তিন. জলবায়ু অভিযোজনকে সহায়তা প্রদান এবং বাংলাদেশে ন্যূনতম কার্বন সম্পৃক্ত উন্নয়নকে উৎসাহিত করা। এতে বজায়ক্ষম প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে দেশে বজায়যোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যাবে।
প্রবৃদ্ধিকে দারিদ্র্যমুখী করতে হলে পাঁচটি বিষয়ের ওপরে মনোযোগ দেওয়া দরকার। এক. কর্ম নিয়োজন, জীবিকা, খাদ্যনিরাপত্তা এবং দারিদ্র্য নিরসনের জন্য উৎপাদনশীল, আধুনিক এবং সৃজনশীল একটি কৃষি খাত গড়ে তোলা। সেই সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতির বিস্তৃত উন্নয়নের জন্য একটি নীতিকাঠামোর প্রতিস্থাপন, যাতে বাংলাদেশের কৃষিবহির্ভূত খাতে বিবিধ কর্মকাণ্ডকে প্রসারিত করা যায়।
দুই. প্রবৃদ্ধিচালিত কর্ম নিয়োজনের পরিবর্তে কর্ম নিয়োজন-চালিত প্রবৃদ্ধি কৌশল অনুসরণ। এ কৌশল অনুসরণ করে যদি কর্ম নিয়োজনের ক্ষেত্র সেই সব খাতে হয়, যেখানে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষেরা বাস করেন, তবে অর্জিত প্রবৃদ্ধি দরিদ্রবান্ধব হবে।
তিন. বাংলাদেশকে নারী এবং বালিকাদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুযোগে আরও বিনিয়োগ করতে হবে। এর ফলে তাঁদের অর্থনৈতিক, আইনগত এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পাবে। নিরাপদ ভৌতকাঠামো (যেমন রাস্তাঘাট); তথ্যপ্রযুক্তির লভ্যতা; ভূমি, ঋণের মতো উৎপাদনশীল সম্পদে নারীর অধিকার তাঁদের ক্ষমতায়নকে সংহত করে। পানি-সুবিধা এবং বিদ্যুৎ তাঁদের কাছে পৌঁছে দিলে নারীদের গৃহস্থালি কাজের বোঝা হ্রাস পাবে।