ইতিহাসের বড় শিক্ষাটা কী? পুরোনো উত্তর– ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। বাতাসের মধ্যে থেকে যেমন বাতাসের অস্তিত্ব বোঝা যায় না, ইতিহাসের অস্তিত্বও একইভাবে সহজে বোঝা যায় না। মানুষ তাই ইতিহাস পড়ার চেয়ে রচনাতেই বেশি ব্যস্ত থাকে। কেবল তাই নয়, ইতিহাস নতুন করে লেখার, ফরমায়েশ দিয়ে নতুন করে বানানোর মতো দাম্ভিকতাও করে। আর এই ভুল করার যাদের অশেষ অধিকার থাকে তারা হলো বিজয়ী শক্তি। ইতিহাস বলতে গেলে বিজয়ী শক্তিই লিখে থাকে। পরাজিত শক্তি ইতিহাসকে লিখতে পারে না, গোপনে বহন করে চলে। সত্যিকার ইতিহাস বুঝতে গেলে তাই সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত হতে হয় বিজয়ী শক্তির ইতিহাসে অন্ধবিশ্বাস স্থাপন করলে।
বিজয়ী শক্তি ইতিহাসকে সবচেয়ে বেশি বিকৃত করে যেভাবে তা হলো: শত্রু-মিত্র বিভাজনে শত্রুকে বাছবিচারহীনভাবে অধমের চেয়ে অধম ও মনুষ্যত্বহীন করে তোলা হয়। এই বিভাজনকে পরে ‘আমরা’ ও ‘তারা’য় রূপান্তর করে এক ভয়ঙ্কর সরলীকরণ করা হয়। তখন যে কোনো রকম বিরোধী, দ্বিমতপোষণকারী ও এমনকি ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধিতে বাধাদানকারীকেও এই সরল বিভাজনের আওতায় এনে ইচ্ছেমত ‘সাইজ’ করা যায়। আর এই বিভাজনের জালটি আশ্চর্যরকমভাবে কেবল প্রসারিতই হতে থাকে। ‘আমরা’ থেকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে হতে ক্ষুদ্রতম ব্যক্তি কিংবা ‘আমি’তে গিয়ে ঠেকে। ‘তারা’র জালে নতুন নতুন শিকার পড়তেই থাকে আর পড়তেই থাকে। এত সহজে এত অসংখ্য ‘তারা’ মাছ জালে ধরা পড়ায় খুশিতে ‘আমি’ আত্মহারা হয়ে ওঠেন। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ওঠেন নেতৃত্বের চূড়ায় বসা ‘আমি’টি।
তখন প্রাকৃতিক নিয়মেই বিপদের ধারালো খাঁড়া মাথার ওপর ঝুলতে থাকে, শুধু একসময় অকস্মাৎ ছিঁড়ে পড়ার অপেক্ষায়। কীভাবে? ‘তারা’ভরা বিশাল ভারি ওই জালটি টুক করে ছিঁড়ে যায়। ধুলায় গড়িয়ে পড়েন বিশাল হীরক রাজার মতো ‘আমি’টি। তবুও ‘আমি’র শিক্ষা হয় না, হীরক রাজারা যুগে যুগে গড়ে ওঠে। ‘আমি’র দৌরাত্ম্য এত বেশি যে, এমনকি ইতিহাসে ধুলায় লালিত-পালিত জনেরাও সুযোগমত হীরক রাজা হয়ে ওঠার লোভ সামলাতে পারে না। জনইতিহাসের কথকেরা তাই আইনস্টাইনের ছোট্ট কাব্যিক সূত্রের মতো সুন্দর করে বলেন, “যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ।”
এ সত্যেরই এক ঐতিহাসিক মূর্তায়ন ছিল বিগত আওয়ামী শাসনামল। যখন বাংলাদেশের পুরো ইতিহাসকে আলাদিনের চেরাগের মতো এক ব্যক্তির গল্পে পরিণত করার চেষ্টা হয়েছিল। ‘আমরা’ আর ‘তারা’র বিভাজন শেষপর্যন্ত পরিণতি পেল ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ এই সমগীতে। জাল যা ছিল একের সুখের ও বহুজনের দুঃখের— তা ছিঁড়ে গেল স্বাভাবিকভাবেই। অথচ জুলাইয়ের আগপর্যন্তও কী শক্তিমান, আত্মতৃপ্ত, অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও চিরবিজয়ী দেখাত সেই ‘আমি’র ধ্বজাধারীদের। এ কেবল বাংলাদেশেই না, সারা বিশ্বেরই চলমান ঘটনা। বর্তমানকালে একে কালার রেভল্যুশন বা রঙের বিপ্লব বলে অনেকে একে একটি খাঁচায় ভরে দেখাতে চান। এদেশে অবশ্য এটি জেন-জি বা নবতরুণ প্রজন্মের বিপ্লব বলে বেশি পরিচিতি পেয়েছি। কিন্তু ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় কি? নেয় না। ইতিহাস নির্বিকারভাবে তার আপন গতিতে চলতেই থাকে।
রূপকথার আমলের রাক্ষস-খোক্ষস হাল-আমলে কার্টুনে বিবর্তিত হয়েছে। সেদিনের দাদি-নানির কাজটা এখন তাই ডিজনি ওয়ার্ল্ড করে থাকে। দাদি-নানির কাছে আব্দারের ঝামেলা নেই আর, বাটন টিপলেই কল্পনারাজ্য এসে হাজির। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র এখন বিদেশে গিয়ে হয়েছেন জে কে রাউলিং। আলাদিনের চেরাগে ঘষা দিতেই দৈত্যের আবির্ভাব এখন হয় কিবোর্ডে টিপ দিয়ে। রূপকথার আমল থেকে ডিজিটাল যুগে টুলসের নাম বদলায় বটে, কিন্তু ফাংশন বা কার্যকারিতা ও বিষয়ের দিক থেকে একই থাকে, কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলেই সব পরিষ্কার দেখা যায়! খালি ও খোলা চোখে এসব দেখা যায় না কিন্তু।
অথচ ইতিহাস কি সত্যি এমন? সূর্য পৃথিবীর চারপাশে, না পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘুরছে? যা সহজে খালিচোখে দেখা যাচ্ছে তা কি সত্যি, না মায়া? মার্কসীয় দর্শনের জন্মের আগে গল্প, উপন্যাস ও কাব্য ছিল একক নায়কে ভরপুর। এখনও মূলধারার নাটক-চলচ্চিত্রে তেমনই। ওই কারণেই বাণিজ্যিক শিল্পে ও ক্রীড়ার আকাশে কেবলই তারকা আর তারকা। কিন্তু গোর্কি, ব্রেখট, নজরুল, সত্যজিৎ ও উৎপল দত্তের মতো শিল্পীদের হাতে প্রচলিত নায়ক হারিয়ে গেলেন, তার জায়গায় এলো ব্যাপক সাধারণ মানুষ। ইতিহাসের ব্যাখ্যায় তা এলো কি? ইতিহাসের গল্প এখনও রূপকথার ঢঙেই লেখা হয় ও হচ্ছে।
কার্ল মার্কস বলেছেন, মানুষ তার নিজের ইতিহাস তৈরি করে, তবে স্বনির্বাচিত পরিস্থিতিতে নয়, বরং অতীত থেকে হস্তান্তরিত বহমান ও ইতিমধ্যে বিদ্যমান পরিস্থিতির অধীনে। সকল বিগত প্রজন্মের ঐতিহ্য জীবিতের মস্তিষ্কে দুঃস্বপ্নের মতো চেপে থাকে।
ইতিহাস কারও অঙ্গুলি হেলনে ওঠবোস করে না, বরং তথাকথিত ঐতিহাসিক নায়কেরাও মঞ্চে সুতায় বাঁধা পুতুল। ম্যাট রিডলি তার দ্য ইভোলশন অব এভরিথিং বইতে লিখেছেন, দিদেরো ও তার বন্ধুরা মত দিয়েছেন যে, ইতিহাসে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদেরকে খুব বেশি কৃতিত্ব দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে অবহেলিত হয়েছে ঘটনাবলি ও পরিস্থিতি। তারা রাজা, সাধু ও এমনকি আবিষ্কারকদেরকে এক ধাপ নামাতে চেয়েছেন। তারা পাঠকদেরকে মনে করিয়েছেন যে, ইতিহাস হলো হাজার হাজার সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে পরিচালিত একটি প্রক্রিয়া, কয়েকজন অতিমানব নায়কের নির্দেশিত নয়।