আরব বসন্তের প্রধান এক স্লোগান ছিল ‘আশ-শাব ইউরিদ ইসকাত আন-নিজাম’ বা ‘জনগণ এই শাসনের পতন ঘটাবে।’ মিসরসহ অনেক দেশে জালিমদের সেই পরিণতি ঘটে। প্রায় দেড় দশক পর বাংলাদেশও অনুরূপ ‘এক দফা’র বাস্তবায়ন দেখেছে। তবে এসব শুধু এক-দুটি ‘দফা’র বাস্তবায়ন ছিল না।
আরব বসন্তের মতো বাংলা বসন্ত ছিল রীতিমতো সামাজিক আত্মার অভ্যুত্থান তথা ইন্তিফাদা বা নাহদার মতো। কিন্তু তারপর কী? আরব বসন্তের সঙ্গে বাংলা বসন্তের আর কোনো তুলনা চলে? আর কিছু সবক নেওয়ার আছে কি না?
আরবে বসন্ত বেশ চঞ্চল ঋতু। ধূলিঝড় হয় তখন। সময়ের হিসাবে ভিন্নতা থাকলেও রাজনীতিতে ‘আরব বসন্ত’ এসেছিল ঝোড়ো তরঙ্গের মতোই। তিউনিসিয়ার হাবিব বোর্গিবা অ্যাভিনিউ থেকে শুরু। তারপর মিসরের তাহরির স্কয়ারের হয়ে ছড়িয়ে পড়া সে-ই ঢেউ এখনো থেমেছে বলে মনে করে না ওই দিকের রাজনৈতিক কর্মীরা। কিন্তু গণজাগরণের এই তরঙ্গকে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনে অনুবাদ করতে পুরো সফল হয়েছে, এমনও বলা যায় না।
এখনকার দক্ষিণ এশিয়া ও তার আশপাশের সঙ্গে মৃদু হলেও মিল আছে মধ্যপ্রাচ্যের ‘বসন্তে’র। মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী বসন্ত এখন সশস্ত্র হয়ে লড়ছে দেশজুড়ে বনে-জলে-স্থলে। শ্রীলঙ্কায় একই ধরনের তরঙ্গ দুই বছর পর নির্বাচনী বিজয় নিয়ে সবে ফিরল কলম্বোর কোট্টেতে। পাকিস্তানে ইমরানের কর্মীরা নির্বাচনে দারুণ চমকের পরও ক্ষমতা পায়নি। বাংলাদেশ আছে পথের মাঝামাঝি। এখানে ছাত্র-জনতা চেষ্টা করছে রাজনৈতিক সংস্কারের।
প্রশ্ন উঠেছে, এশিয়ার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে কাছাকাছি থাকা এই দেশগুলো কি গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী আরব বসন্তের ভুলগুলো এড়িয়ে যেতে পারবে? নাকি ধারাবাহিক অস্থিরতা-সহিংসতা, আদর্শগত বিরোধ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর আমলাতন্ত্রের অসহযোগিতায় তারা রাজনৈতিক পরিবর্তনে ব্যর্থ হয়ে যাবে? এ রকম জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজতে চলতি বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা গত দশকের মিসর-লিবিয়া-সিরিয়া-তিউনিসিয়ায় ঘুরে আসতে পারি। হয়তো এ রকম ফিরে দেখা জরুরিও।
অর্থনৈতিক সংস্কার ও পুরোনো এলিটদের কর্তৃত্ব
আরব বসন্তের ভেতর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সমাজের নিচতলায় মানসিক একটা জাগরণ ঘটে যায়। ভয়ের সংস্কৃতি পেছনে ফেলে জেগে ওঠে মানুষ। বসন্তের শুরুই হয়েছিল শ্রমজীবীদের দ্বারা। চলমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্কে বিপর্যস্ত ছিল তারা। স্বাভাবিকভাবে অভ্যুত্থানের ঢেউয়ে কুখ্যাত শাসকেরা একের পর এক বিদায় নেওয়া শুরু করলে প্রায় সব সামাজিক গোষ্ঠী বহুকালের বঞ্চনা ও নিপীড়নের প্রতিকার চাইতে শুরু করে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত চাইছিল আয় ও বাজারদরে ভারসাম্য থাকুক।
নতুন শাসকদের পক্ষে এসব প্রত্যাশা পূরণ সহজ ছিল না। গণতান্ত্রিক পন্থায় বাজার মাফিয়া ও পুরোনো কুলীনদের প্রভাবের জায়গা থেকে সরানো দুরূহ ছিল। অভ্যুত্থানে নিচুতলার মানুষের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বাড়ালেও অর্থনৈতিক সংস্কার ছাড়া শেষমেশ শাসক-এলিটদের কর্তৃত্ব খর্ব করা যায়নি।