ইদানীং প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস প্রশাসনের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই ধারায় বিপ্লবের মতাদর্শ এবং ম্যান্ডেটের স্বীকৃতি কিছুটা অনুপস্থিত বলে মনে হয়। পতিত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার তো সংবিধান অনুযায়ীই গঠিত হয়েছিল, হোক না তা কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে; তাহলে জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর বিপ্লব কোন কাগুজে আইনি বৈধতা বলে সম্পাদন করল ছাত্র-জনতা?
ইতিহাসে এমন সময় আসে যখন রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়াবলি কাগজে লিপিবদ্ধ থাকে না; বরং নতুন করে লেখার পরিবেশ তৈরি করে সংঘবদ্ধ মানুষ। এই ধারণার নাম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ রুশোর ভাষায়, ‘পিপল’স উইল’ বা জনগণের ইচ্ছা, যা বাংলাদেশে প্রমাণিত হয়েছে ফ্যাসিবাদী শাসনের ইতি ঘটানো কোটি জনতার মিছিলে।
সুতরাং সংবিধান নামক বইটি যদি সাধারণ মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়, তাহলে এটি তাদের বোঝাপড়ার মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়। যদিও আমাদের বাস্তবতায় জনমত পরের কথা, সংবিধানের বিষয়বস্তু তাদের মাথার অনেক ওপর দিয়ে চলে যায়। এর ধারা, উপধারার পাঠোদ্ধার করতেই বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিতে হয় হয়। ভবিষ্যতে হয়তো দিতে হবে না।
যেমন কেউ কেউ ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪-এর (কারচুপির) নির্বাচনের আগে উচ্চমার্গীয় কায়দায় বলতেন, ভোটানুষ্ঠান না হলে কিন্তু সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। ভেবে দেখুন তো, তাদের বক্তব্য কার পক্ষে যেত এবং তাদের অবস্থান আজ বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে?
হাসিনা আমলের সংবিধানও রাজনৈতিক ও অন্যান্য সংকটের একটি বড় কারণ। তাঁর লোকেরা সর্বরোগের ওষুধ বলে দাবি করতেন ১৯৭২ সালের সংবিধানকে। এর ফল হিসেবে পরবর্তী সময়ে জাতি দেখেছে ১৯৭৩-এর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, জাসদের সশস্ত্র শ্রেণিসংগ্রাম এবং ১৯৭৫-এ একদলীয় বাকশালব্যবস্থা কায়েম।
এসব বিবেচনায় ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত বর্তমান সরকার একটি সাংবিধানিক সংস্কার কমিশনকে সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন কমিশন আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কীভাবে সংবিধান ‘পুনর্লেখন’ সম্পন্ন করবে, সেটি দেখার বিষয়।
এর মধ্যে সবচেয়ে দুরূহ কাজ হবে জনপ্রত্যাশা মেটানো এবং নতুন সংবিধানের পক্ষে রাজনৈতিক ঐকমত্য নিশ্চিত করা। যাতে আগামী নির্বাচনের পর গঠিতব্য সাংবিধানিক সভা বা প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ কমিশনের প্রস্তাবিত দলিলটি চূড়ান্ত করতে পারে এবং এরপর গণভোটে জনগণ অনুমোদন দিতে পারে।
এই তিন মাসে কমিশন দেশের সব প্রান্তের জনগণ, নাগরিক গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক শক্তিকে সম্পৃক্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ নতুন সংবিধান রচনা করবে নাকি পূর্ববর্তী সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনীর সংশোধন এবং ব্যত্যয়গুলো দূর করার প্রস্তাব দেবে, সেটিও ঠিক করতে হবে।