বাকস্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার এই আমলে জানা যাচ্ছে যে পুলিশের ওসিরা শুধু ঢাকার যেকোনও এক থানায় বদলি নিতে দুই কোটি টাকা ঘুষ দিতো। এমনটা এখন আর কোনও গল্প নয়; বেনজীরসহ পুলিশের কর্তাব্যক্তিদের সম্পদের বহর দেখলে বোঝা যায়, এই ঘটনা কোনও রটনা নয়। শুধু পুলিশ কেন? বেশিরভাগ নির্বাহী বিভাগের আমলা, ডাক্তার, বিচারক, শিক্ষক সবাই ঢাকায় আসতে মরিয়া। অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকলেও আর্থিক বা নাগরিক সুযোগ-সুবিধার চাহিদা যে এখানে মুখ্য, তা আর বুঝতে বাকি থাকে না।
বাংলাদেশ যেন শুধুই ‘ঢাকা’! ঢাকাতে গ্রামীণফোনের অফিসও থাকতে হবে, আবার বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদর দফতরও রাখতে হবে। অথচ দুটোর কোনোটাই ঢাকাতে রাখার যৌক্তিকতা ছিল না। অসম উন্নয়নের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত ঢাকার আজকের অবস্থান। যাবতীয় সরকারি অফিস ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর দিয়ে ঢাকাকে ভরিয়ে রাখা। তাই যাবতীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, যেমন- ভালো স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, শপিং মল সবই ঢাকাকেন্দ্রিক। সরকারি বা বেসরকারি, কোনোভাবেই দেশের কিছু বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি।
এমনকি অষ্টম সংশোধনী বাতিলের রায় যেসব সমালোচনা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল, তার মধ্যে একটি ছিল কেন্দ্রিককরণের দোহাই দিয়ে ঢাকার প্রতি পক্ষপাত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক চরিত্রের মধ্যে ‘এক গভীর সম্পর্ক’ অঙ্কিত হয়েছিল ওই রায়ে। সেই বিতর্ক বা সমালোচনা এখনও জারি আছে। এখনও অনেকেই মনে করেন যে এরশাদ সরকার যেসব কাজ করে গেছেন, তার মধ্যে অষ্টম সংশোধনী অন্যতম ছিল, যার মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আদালতের রায়ে ওই সংশোধনী টেকেনি। বাজারে আলোচনা ছিল যে বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই ঢাকা ছাড়তে চান না; তাই ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থায়ী করলে তাদের বিস্তর অসুবিধা।
বিগত রাজনৈতিক সরকারগুলোর শাসনামল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ঢাকার কিছু বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ সুবিধা বরাদ্দের মাধ্যমে তাদের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারগুলোর কর্তাব্যক্তিদের হোমডিসট্রিক্ট হওয়ার কারণে গোপালগঞ্জ, বগুড়া আর রংপুরে অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেক বেশি বাজেট ও প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
শুধু স্থাপনা নয়, এসব অঞ্চলের বাসিন্দারা তাদের আঞ্চলিকতার জন্য রাজনৈতিক সরকারের কাছ থেকে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কতিপয় অঞ্চল উন্নয়নের ছোঁয়া পেয়েছে শুধু সরকার প্রধানদের ব্যক্তিগত ইচ্ছায়। অন্য অঞ্চলগুলোর যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও থেকে গেছে অনুন্নত ও অবহেলিত। কোনও সাংবিধানিক পরিকাঠামো না থাকায় রাষ্ট্রের জেলাসমূহকে নির্ভর করতে হয় রাজনৈতিক নেতাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছার ওপর। সর্বোচ্চ নেতৃত্বের বাপের বাড়ি বা শ্বশুরবাড়ি না হলেও, প্রভাবশালী মন্ত্রীর বাড়ির এলাকাতেও কিছুটা সম্ভাবনা তৈরি হয়।
যেসব জেলায় সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা থাকেন না, সেখানে পৌঁছায়ও না উন্নয়নের ছোঁয়া।
বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে অর্থাৎ ১০নং অনুচ্ছেদে সমাজতন্ত্র ও শোষণ থেকে মুক্তির কথা ও ১৬নং অনুচ্ছেদে গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লবের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ থাকলেও রাষ্ট্রের অনেক জেলায় এখনও সরকারের সুষম উন্নয়ন হয়নি। বাংলাদেশ যদিও সাংবিধানিকভাবে এখনও এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র, কিন্তু এখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রয়োগ সম্ভব। যেহেতু বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন সংবিধান তৈরির জোরালো দাবি উঠেছে, তাই সেখানে সুশাসন নিশ্চিত করতে ও রাষ্ট্রের সব এলাকার সুষম উন্নয়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বিধান রাখা প্রয়োজন।