অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তি উপলক্ষ্যে ১০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ প্রদান করেছেন, তাতে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রকাশ পেয়েছে। আর সেই রূপরেখায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের উদ্যোগের কথা বলেছেন তিনি। তার বক্তব্যে উঠে এসেছে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগের কথা, অর্থনীতির চাকা সচল রাখার কথা, ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা কার্যক্রম পরিবর্তনের কথা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির কথা, ওষুধ শিল্প ও তৈরি পোশাক শিল্পের কথা, নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের কথা, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার কথা, গুম সংস্কৃতি ও আয়নাঘরগুলোর কথা, সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিতের কথা, লুটপাট ও পাচারের অর্থ উদ্ধারের কথা, বাজারব্যবস্থার কথা ইত্যাদি। বলা যেতে পারে, সংক্ষেপে তিনি পুরো দেশের অবক্ষয়ের চিত্র যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি তা থেকে উদ্ধারে প্রয়োজনীয় সংস্কারের অপরিহার্যতার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
দীর্ঘদিনের অপশাসনে সৃষ্ট সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ভঙ্গুর অবস্থা থেকে জাতিকে রক্ষার লক্ষ্যে তিনি সংস্কারের কথা বলেছেন। সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে তিনি ছয়টি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। কমিশন ছয়টির কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে কমিশনপ্রধানের দায়িত্ব অর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে গঠিত সংস্কারের এ ছয়টি কমিশন হলো-নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন। এসব কমিশন আগামী ১ অক্টোবর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করবে এবং তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট দাখিল করতে সক্ষম হবে। কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্রসমাজ, নাগরিকসমাজ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে ব্যাপক ভিত্তিতে একটি পরামর্শ সভার মাধ্যমে সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করবেন। এরপর অন্যান্য বিষয়েও কমিটি গঠন করে কর্মপন্থা নির্ধারণ করা প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধান উপদেষ্টার এ পরিকল্পনা তাৎক্ষণিকভাবে সব মহলে প্রশংসিত হয়। রাজনৈতিক মহলের মধ্যে যারা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্মলগ্ন থেকে অতিদ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন চেয়ে আসছেন, তারাও এ বিষয়ে দ্বিমত করতে পারেননি। তবে তাদের মধ্যে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান উপদেষ্টার সংস্কারের কাজগুলোর প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করলেও একইসঙ্গে সংস্কার কার্যক্রম অবশ্যই খুব দ্রুত সমাপ্ত করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আসা অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন। তবে জনগণ তাদের ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার দেখতে চায় বলে তিনি স্পষ্টতই জানিয়ে দেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথাটির মর্মার্থ আমার কাছে মনে হয়েছে এরকম : সংস্কার করুন আর যাই করুন, অতিদ্রুত করুন এবং দ্রুত সংসদ নির্বাচন দিন। আমাদের পক্ষে আর সময়ক্ষেপণ করা সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি চুটকির সঙ্গে বিষয়টির বেশ মিল খুঁজে পাচ্ছি। চুটকিটি সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। সদ্য বিয়ে করে আনা নববধূর কাছে দাদি-শাশুড়ি এসে বলল, ‘বউ, আমার বয়স হয়েছে সময় নাই, আমি দ্রুত পুতির মুখ দেখতে চাই।’ একটু পরে শাশুড়ি এসে বলল, ‘আমি নাতি চাই।’ আরও পরে ননদ বলল, ‘ভাইপো চাই আমি, দেরি করা চলবে না।’ সন্ধ্যায় দেবরেরও একই কথা। রাতে বাসরঘরে স্বামী এসে যেভাবে তার কথা শুরু করল তা হলো, ‘আমি সন্তানের মুখ দেখতে দেরি করতে পারব না।’ নববধূ এ কথার উত্তর কী দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। একবার ভাবল, হয়তো এ বাড়ির সবাই পাগল। আবার ভাবল, আগে জানলে রেডিমেড একটা বাচ্চা নিয়েই আসতাম।
অতিদ্রুত সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার বিষয়টি অনেকটা এরকম নয় কি? অথচ ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের লক্ষ্যই ছিল নতুন বাংলাদেশ গড়ার। এ আন্দোলনে তখনকার সরকারি দল ও সরকারি দলঘেঁষা জোট ছাড়া বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল পূর্ণ সমর্থন ও একাত্মতা ঘোষণা করেছিল। শুধু ঘোষণাই করেনি, আন্দোলনেও নেমেছিল। ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগে বিএনপি ৩ মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি উপস্থাপন করেছিল। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও কমবেশি এরকম অবস্থায়ই ছিল। এর উল্লেখযোগ্য কারণ হতে পারে, দীর্ঘদিন ধরে তারা একতরফা নির্বাচন দেখেছে। দেখেছে দেশের শাসনব্যবস্থায় আওয়ামী লীগের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো একটি অবস্থান। এ একতরফা অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য তাদের প্রধান দাবি ছিল, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করা। তারা ‘পুরোনো বাংলাদেশের’ বলয়ের মধ্যেই আবদ্ধ ছিলেন। শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন চেয়েছিলেন।