সম্ভবত ২০২২ সালের ঘটনা। ভদ্রলোক টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক বা ডিসি। আওয়ামী শাসনের তখন জোয়ারকাল। একটা অপেক্ষাকৃত ছোট জেলার ডিসির দায়িত্ব পালন করে থিতু হয়েছেন টাঙ্গাইলে। সাহিত্যের ছাত্র এই জেলা প্রশাসকের বই পড়ার বাতিক প্রবল। টাঙ্গাইলের মতো জেলার জটিল সব কাজকর্ম সামলে নিয়মিত বই পড়েন বলে খবর পেলাম। তার ব্যাপারে একটু উৎসাহিতও হলাম। একটা সুযোগ মিলল তার সাক্ষাৎ পাবার। বড় আয়োজন। গোটা জেলার সব কর্মকর্তাদের নিয়ে বসেছেন এক দাওয়াতে। জেলার পুলিশ প্রধান এসপিও আছেন সেখানে।
বিরাট হলরূমে এই আয়োজনে ডিসি ও এসপির মাঝখানে একটা চেয়ার। অনুষ্ঠান শুরুর জন্য সেই চেয়ারের অতিথির আগমনেরই অপেক্ষা। ভাবলাম জেলার মন্ত্রী বা গণ্যমান্য বোধ হয় কেও আসছেন। নিদেন পক্ষে স্থানীয় সংসদ সদস্য বা মেয়র বা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক। তখন সেটাই রেওয়াজ। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায়। ২০২৪ সালেও তারাই আসছেন আবার ক্ষমতায়, সেই বয়ানও চলছে। জেলা প্রশাসকরা আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদল ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগও রাখেন না। ওটাই তখনকার কালচার।
হঠাৎ দেখলাম ডিসি সাহেব চঞ্চল হয়ে উঠলেন। কেউ একজন আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এলেন তিনি। তার জন্যেই অপেক্ষা। হলরূমে থাকা নারী, শিশুসহ প্রায় শ দেড়েক লোক বসে ছিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু করা যায়নি সেই বিশেষ মানুষটির জন্য। একটু উৎসুক হয়ে উঠলাম। দেখলাম ডিসি সাহেব তাকে সমাদরে বসালেন তার ও এসপি সাহেবের দুই চেয়ারের মধ্যখানে, অনুষ্ঠানের মধ্যমণি করে। কে এই ভদ্রলোক? মন্ত্রী নন, এমপি নন, আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকও নন! খোঁজ নিয়ে জানলাম, তার নাম খন্দকার তারিকুল ইসলাম। পেশায় তিনি একজন ঠিকাদার। 'নূরানি কন্সট্রাকশন' নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী। তখন সেই জেলার সব বড় বড় কাজ তিনিই করেন একচ্ছত্রভাবে। এরকম একটা অনুষ্ঠানে একজন ঠিকাদারকে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন, ডিসি সাহেব? কিছুক্ষণ পরেই গোমর ফাঁক হলো। তিনি হচ্ছেন জেলার ক্ষমতাধর তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের মামাতো ভাই। মন্ত্রীমহোদয়ের ঘনিষ্ঠই শুধু নন তার আর্থিক শক্তির যোগানদারও বটে। মন্ত্রীর আত্মীয়, মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন, এই তারিককে তাই ডিসির এরকম অতিরিক্ত খাতির!
বিষয়টা মন থেকে তাড়াতে পারিনি। মন্ত্রীর আত্মীয় হলেও একজন ঠিকাদারকে সবার সামনে ডিসি-এসপির মাঝখানে চেয়ার দিয়ে জেলার সব বিভাগের অফিসার ও তাদের পরিবারের সামনে এভাবে খাতির করাটা কতটা শোভন? ডিসি ভদ্রলোককে তো সংস্কৃতিমনা মানুষই ভেবেছিলাম। তাহলে নির্লজ্জভাবে মন্ত্রীর আত্মীয় তোষণ কেন? একজনের কাছে জানতে চাইলাম। বললেন, মন্ত্রীকে খুশি রাখতেই ডিসির এই লাজলজ্জাহীন 'তারিক-তোষণ'।
আজ বহুদিন পরে নিজের চোখে দেখা সেই ঘটনাটা মনে পড়ল। সেই নির্লজ্জ কাজের পুরষ্কার তিনি পেয়েছিলেন। নির্বিঘ্নে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব শেষে যথাযথ প্রমোশন ও ভালো পোস্টিং পেতে তার কোনো অসুবিধা হয়নি।