শিক্ষার্থীরাই দেশের ভবিষ্যৎ-এ কথাটি আমরা সবাই সবসময়ই বলি। কিন্তু এদের কল্যাণার্থে আমরা আসলে কিছুই করছি না। কিছু ভাগ্যবান ছাড়া প্রায় সব শিক্ষার্থী অনেকটা অবহেলা বা অবজ্ঞার মধ্য দিয়েই শিক্ষাজীবন শেষ করছে। শিক্ষার্থীদের কী প্রয়োজন, কেন প্রয়োজন, কীভাবে তাদের প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব, তা কোনোকালেই রাষ্ট্রের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসাবে পরিগণিত হয়নি। অথচ এ শিক্ষার্থীরাই ভাষার জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য, বৈষম্যের অবসানের জন্য জীবন দিয়েছে।
শিক্ষার্থীদের কাছে জাতি নানাভাবে ঋণী। দুঃখজনক হলো, তাদের রক্তের বিনিময়ে তারা কিছুই পায়নি। আন্দোলন শেষ হয়, দেশ চলে দেশের মতো। শিক্ষার্থীদের জন্য কিছুই হয় না। কিছুই হয় না বলা হয়তো ভুল হবে। আসল কথা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা এটা চায়, ওটা চায়; কিন্তু নিজেদের জন্যও যে কিছু চাইতে হবে তা তারা ভুলে যায়। এবার শিক্ষার্থীরা সরকারের সঙ্গে যুক্ত আছে এবং অনেক নীতিনির্ধারণী বিষয়েও তারা মতামত দিচ্ছে। কিন্তু তারপরও শিক্ষার্থীদের যে সমস্যাগুলো আছে, তা সমাধানে এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। এ লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মনে করিয়ে দেওয়া, শুধু দেশের সমস্যার সমাধান নয়, তাদের সমস্যারও সমাধান প্রয়োজন।
সিট ও খাবার মান : শিক্ষার্থীদের প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম হচ্ছে হলের সিট সমস্যা। এ সিট সমস্যাকে কেন্দ্র করেই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে ছাত্ররাজনীতি। মারামারি, কাটাকাটি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি যত ধরনের অন্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়, তার প্রায় বেশিরভাগই সংঘটিত হয় সিট সমস্যাকে কেন্দ্র করে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া হলে গাদাগাদি করে থাকা অথবা মেসের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকাই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের জন্য অমেঘ পরিণতি। পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তবুও থাকার কিছু ব্যবস্থা আছে, কিন্তু নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা দূরের কথা, ক্লাস করার জন্য পর্যাপ্ত রুম পর্যন্ত নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর খাবারের মান বলে কিছু নেই। দীর্ঘদিন থেকেই চলছে অপুষ্টিকর খাবার পরিবেশনার প্রতিযোগিতা। দিন দিন খাবারের মান কমছে এবং খাবারের মূল্য বাড়ছে। অনেক সময়ই শিক্ষার্থীরা এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছে, অনেক অনাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু খাবারের মান বৃদ্ধি পায়নি এবং মূল্যও কমেনি। অতীতে শিক্ষার্থীদের খাবারের জন্য সাবসিডির ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বর্তমানে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় সেই সাবসিডির ব্যবস্থা নেই বা থাকলেও আছে নামমাত্র। ফলে আমাদের সন্তানদের জন্য মানসম্মত খাবার শুধু স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে।
বৃত্তি ও শিক্ষা ঋণ : মেধাবী শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত এবং অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার জন্য শিক্ষা বৃত্তি অত্যন্ত প্রয়োজন। বিশ্বের অন্যান্য দেশে মেধাবীদের পাশাপাশি অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের তাদের পরিবারের আর্থিক সংগতির ভিত্তিতে বৃত্তি প্রদান করা হয়। আমাদেরও বৃত্তির ব্যবস্থা আছে, তবে বৃত্তির সংখ্যা এবং বৃত্তির পরিমাণ অতি সামান্য। বৃত্তির পাশাপাশি উন্নত বা উন্নয়নশীল বিশ্বে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য বিনাসুদে শিক্ষা ঋণের ব্যবস্থা আছে, যা চাকরি পাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা কিস্তিতে পরিশোধ করে। আমি যে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জিপিএ ৩.২৫ পেলে শিক্ষা ঋণ মওকুফ করা হতো। আমাদের দেশে এরূপ কোনো ব্যবস্থা নেই।
উচ্চ টিউশন ফি : সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করছে তারা ভাগ্যবান; কারণ তাদের খুব সামান্য টিউশন ফি দিতে হয়। কিন্তু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষে সব যোগ্য শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য সুযোগ প্রদান করা সম্ভব নয়। ফলে অনেক শিক্ষার্থীকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে হচ্ছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উদ্দেশ্য যদিও মানবতার কল্যাণ, কিন্তু টিউশন ফি দেখে মনে হয়, অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যটি যথেষ্ট মাত্রায় বেশি। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর টিউশন ফি তো বলা চলে আকাশচুম্বী। কেন এত টিউশন দিতে হবে তার কোনো উত্তর নেই? তবে উচ্চ টিউশন ফির টাকায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা গড়ছে এবং ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের বা অন্যদের জন্য নতুন মডেলের গাড়ি ক্রয় করছে। কিন্তু টিউশন ফি কমানোর কোনো কথা নেই। অতীতে টিউশন একটি সহনশীল পর্যায়ে আনা যায়নি, তবে এ ব্যাপারে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার সময় এখন এসেছে।