ঘুস-দুর্নীতির সঙ্গে কাজের, বিশেষ করে সরকারি কাজের কি কোনো সম্পর্ক আছে? প্রশ্নটির উত্তর এত সহজ নয়। ঘুসের সঙ্গে সরকারি কাজের কী সম্পর্ক, তা নিয়ে জনগণের একটা ধারণা আছে। এমনকি ধারণা আছে সরকারের কর্তাব্যক্তিদেরও। এ সম্পর্কে সাবেক অনেক মন্ত্রী, বিশেষ করে অর্থমন্ত্রীরা বেশকিছু মন্তব্য রেখে গেছেন। বলে গেছেন, ঘুস ছাড়া কাজ হয় না। অনেকে অবশ্য সরকারি অফিসের এ ঘুসকে ‘টেবিল মানি’ বলেন। অনেকে ভদ্রভাবে বলেন ‘স্পিড মানি’। কত সুন্দর নাম! যত না সুন্দর, তার চেয়ে বেশি ভীতিকর। কারণ এ ঘুস-দুর্নীতি আমাদের তিলে তিলে খাচ্ছে।
সমস্যাটি এবং এর সমাধানের ক্ষেত্রে কী কী করণীয় এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য একটি ঘটনা বলি। ঘটনাটি মতিঝিলের বিখ্যাত একটি বাণিজ্যিক অফিসের। কয়েক বছর আগের কথা। চৌকশ একজন নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এলেন বিদেশে চাকরি করার অভিজ্ঞতা নিয়ে। অন্যরা যা করেন, তিনিও তাই করলেন। সবাইকে তিনি ডাকলেন। এ ধরনের অবস্থায় সবাই একটু সতর্ক থাকে বোঝার জন্য-নতুন কর্তা কী চান। তিনি বলতে শুরু করলেন, প্রতিষ্ঠানটি ঠিকমতো চলছে না। দক্ষ লোকের অভাব। নিয়মিত অফিসার-কর্মীরা অফিসে আসেন না। যখন খুশি আসেন, যখন খুশি যান। কোনো জবাবদিহিতা নেই। অফিসাররা ‘টাই’ পরেন না, কর্মচারীদের ‘ইউনিফরম’ নেই। অফিসারদের খাওয়ার জন্য ডাইনিং হল নেই। গাড়িতে তেল খরচ বেশি। সেখানে বিশাল অপচয়। মেডিকেল বিলের ক্ষেত্রে বিশাল অপচয় হয়। এ ধরনের নানা অসুবিধা ও সমস্যার কথা তিনি সেদিন বলে সবাইকে ‘বিহেইভ’ করতে বলেন। বলেন, ‘বোনাস’ ঢালাওভাবে দেওয়া হবে না, এমনকি বার্ষিক বেতন বৃদ্ধিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে হবে না। তিনি প্রথমেই ধরলেন ‘উপস্থিতি’ সমস্যাকে। প্রধান কার্যালয়ে মেশিন বসালেন। সবাই কার্ড ঢুকিয়ে তারপর অফিসে ঢুকবে। অফিসে ঢোকার সময় রেকর্ড হবে। শাখায়-শাখায় উপস্থিতি মেশিন বসল। ভীষণ কড়াকড়ি। কর্মচারী-কর্মকর্তারা তটস্থ। কার চাকরি কখন যায়। ওদিকে তিনি হুকুম দিলেন সব গাড়ির ‘মাইলেজ’ টেস্ট করাতে। করবে নামকরা প্রতিষ্ঠান। এক লিটার তেলে কত মাইল/কিলোমিটার একটি গাড়ি যায় তার হিসাব হবে। ড্রাইভাররা ওইভাবে তেল তুলবে। দুর্নীতি বন্ধ হবে। দক্ষতা বাড়বে। নতুন জমানা, নতুন এমডি, নতুন উদ্দীপনা। ভয়ে ভয়ে সবাই কাজ শুরু করল। একদিন খবর পাওয়া গেল ‘উপস্থিতি মেশিন’ নষ্ট হয়েছে। তারপর খবর এলো অনেক অফিসেও তা খারাপ হচ্ছে। ‘সাপ্লায়ার’ মেরামত করছে। বিল তুলছে। দেখা গেল ‘সাপ্লায়ার’ মহামান্য ‘এমডি’ সাহেবের খালাতো ভাই। যাক সমস্যা শেষ। কারণ একদিন মেশিনই গায়েব হয়ে গেল। শুরু হলো ‘ইনভেস্টিগেশন’। এর ওপর দোষ, ওর ওপর দোষ। অফিসাররা একজন আরেকজনকে ঘায়েল করার জন্য উঠেপড়ে লাগল। এদিকে গাড়ির অবস্থা কী? দেখা গেল গাড়ি সব নষ্ট হতে শুরু করেছে। ড্রাইভারদের অনেক অভিযোগ। তারা সংঘবদ্ধ। তাদের সমিতি আছে। মতিঝিলে ড্রাইভাররা একতাবদ্ধ। শেষ পর্যন্ত আগের রীতিই বহাল হলো-উপস্থিতিতে এবং গাড়ির ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে ‘এমডি’ সাহেবও তার গদি ঠিক করে নিয়েছেন। দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করতে গিয়ে ফলাফল হলো শূন্য। এটাই বাস্তবতা।