স্বাধীনতা ও বিজয় রক্ষা করা বিজয় অর্জনের চেয়ে কঠিন। যেমন, স্বৈরশাসকরা কেবল মুকুট পরতে জানে, কিন্তু তারা মুকুট ছাড়ার পথ জানে না বা চেনে না। চাটুকারবেষ্টিত চরম কর্তৃত্ববাদী ও স্বেচ্ছাচারীদের ধ্বংস ও বিনাশের চাবি কোন বাতিঘরে লুকানো থাকে, তা তারা আন্দাজ করতে পারে না। বিশ্বের সব স্বৈরাচারীর রীতিনীতি ও মূলমন্ত্র প্রায় এক ও অভিন্ন। তারা অনেকটাই নেশার ঘোরে চলে। হুঁশ ও জোশের তাল-লয়ে ঘাটতি থাকে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, হঠাৎ কোনো ছোট্ট ঝড়ের কবলে পড়ে স্বৈরাচারদের সুরক্ষিত নিরাপদ নিবাস তছনছ হয়ে যায়। অথচ বৃহৎ ইনফ্লুয়েন্সিয়াল প্যারামিটার (অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশক্তি), প্রচুর রক্তপাত, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, জন-অসন্তোষের প্রতিধ্বনির পারদ চরমে উঠলেও গদির বিনাশ হয় না। অথচ ক্ষুদ্র কারণে মসনদের পতন হয়। এর বাস্তব উদাহরণ বাংলাদেশ।
গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে সংঘটিত বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বিশ্বরাজনীতির পাঠচক্রে এক আর্কষণীয় অধ্যায় হিসাবে থাকবে। এর প্রয়োজনীয়তা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহসাই ফুরিয়ে যাবে না, বরং এর আবেদনটা থেকে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। এটি একটি থিম গেম। উত্থান-পতন।
খেয়াল করলে দেখা যায়, যে স্বাধীনতাবিরোধী বা ‘রাজাকার’ শব্দের চটকদার স্টিগমা বা সুকৌশল ব্যবহারে পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের উত্থান ও জয়যাত্রা, সেই একই শব্দের (রাজাকার) অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগের মধ্যে তার পতন নিশ্চিত হলো। বিধির কী খেলা!
বস্তুত যখন কোনো সরকার বা প্রশাসন অবজেক্টিভলি দূরাচার হয় ও নৈতিক অবক্ষয়ের বাহক হয় এবং তার চারপাশ হয় তোষামোদকারী বা চাটুকার পরিবেষ্টিত, তখন তারা কর্ণকুহরে কেবল কোকিলের গানই শুনতে পায়, শুনতে পায় না জনগণের হাহাকার ধ্বনি ও নির্যাতিত নিষ্পেষিত মানুষের গোঙানি।
এ গোঙানির ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েই সমাজ বা জনগণের ভেতরে তৈরি হয় স্পার্টাকাস, গ্ল্যাডিয়েটর। এ স্পার্টাকাস, গ্ল্যাডিয়েটরা তখন তক্ত-মসনদের শেকড়কে তুলার মতো উড়িয়ে দেয়, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশ।
সবকিছু মজবুত, সব ঠিক আছে, উন্নয়নের বুলি বারবার জাতির সামনে সগৌরবে আওড়ানোর পরও এমন অপমানজনক ও অসম্মানজনক পতন কেন হলো? এ পতনের উত্তর জনগণ জানে। পতিত শাসকগোষ্ঠীও জেনেছিল ও বুঝেছিল। কিন্তু সমস্যা হলো-মানেনি, মানতে চায়নি। ওই যে আমিত্ববোধ, আমিই সব। এখানেই সব আটকে ছিল, যার ফল বড্ড তেতো হলো।