হাসনাত কাইয়ুম সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক। হাওরের মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবন্দী হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ জেলে ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা। ‘হাওর অঞ্চলবাসী’ এবং নদী-পানি-পরিবেশবিষয়ক সংগঠনসমূহের নেটওয়ার্ক ‘জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশন বাস্তবায়ন আন্দোলন’-এর সমন্বয়ক হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে সংবিধান সংস্কার নিয়ে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার সঙ্গে।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে সংবিধান সংস্কারের প্রসঙ্গ উঠেছে। আমাদের সংবিধান সংস্কার কেন জরুরি?
হাসনাত কাইয়ুম: অভ্যুত্থানের অনেক আগে থেকে আমরা এ কথাটি বলে আসছি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট যা-ই বলুন না কেন, সব সংকটের শিকড়ের ব্যাপার হলো সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামো। এ সংবিধান যেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে নির্ধারণ করেছিল, একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের যে ঘোষণাপত্র ছিল—সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে এ ক্ষমতাকাঠামো। বাংলাদেশের সংবিধানের মূল নীতি মূলত চারটি। এর বাইরে আরও অনেক নীতি আছে। নতুন রাষ্ট্র পত্তনের যে দর্শন ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেসব বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের ক্ষমতাকাঠামো দরকার, সংবিধানে আছে তার বিপরীত। সংবিধানের মূলনীতিতে ‘গণতন্ত্র’-এর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা এক ব্যক্তি বা একটি পদে সোপর্দ করা হয়েছে। সেখানে কোনো ধরনের জবাবদিহির ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
আরেক মূলনীতি হিসেবে ‘সমাজতন্ত্র’ আছে। তবে লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, লুটপাট, পাচার—সবকিছু করা যাবে, কিন্তু কেউ এতে বাধা দিতে পারবে না। সে জন্য আমরা বলছি, বাংলাদেশের মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের যে অঙ্গীকার ছিল, সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামোকে যেভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে, সেটাকে পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন-উপযোগী ক্ষমতাকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। বিগত ৫৩ বছরে এটা করা হয়নি। জনগণ বহু আন্দোলন করেছে, বিজয়ী হয়েছে কিন্তু বিজয়ের ফল বেহাত হয়ে গেছে। জনগণের সম্পদ, স্বাধীনতা, সম্মান লুণ্ঠিত হয়েছে। এর সবই হয়েছে আইনের মাধ্যমে, সংবিধানের ক্ষমতা দিয়ে। তাই সংবিধানের এই অন্যায্য ক্ষমতাকে পরিবর্তন করতে হবে। সংবিধান সংশোধন করে করা যাবে না, আবার এটা করার জন্য আপাতত পুরো সংবিধান ফেলে দেওয়ারও দরকার নেই। সংবিধানের ক্ষমতা অংশটাকে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী করে পুনর্বিন্যাস করলেই চলে। এ পরিবর্তন করাটাকেই আমরা সংবিধানের সংস্কার বলি। এটাই এখানকার মানুষের সমস্যা সমাধানের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আরেক মূলনীতি হিসেবে ‘সমাজতন্ত্র’ আছে। তবে লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, লুটপাট, পাচার—সবকিছু করা যাবে, কিন্তু কেউ এতে বাধা দিতে পারবে না। সে জন্য আমরা বলছি, বাংলাদেশের মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের যে অঙ্গীকার ছিল, সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামোকে যেভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে, সেটাকে পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন-উপযোগী ক্ষমতাকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। বিগত ৫৩ বছরে এটা করা হয়নি। জনগণ বহু আন্দোলন করেছে, বিজয়ী হয়েছে কিন্তু বিজয়ের ফল বেহাত হয়ে গেছে। জনগণের সম্পদ, স্বাধীনতা, সম্মান লুণ্ঠিত হয়েছে। এর সবই হয়েছে আইনের মাধ্যমে, সংবিধানের ক্ষমতা দিয়ে। তাই সংবিধানের এই অন্যায্য ক্ষমতাকে পরিবর্তন করতে হবে। সংবিধান সংশোধন করে করা যাবে না, আবার এটা করার জন্য আপাতত পুরো সংবিধান ফেলে দেওয়ারও দরকার নেই। সংবিধানের ক্ষমতা অংশটাকে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী করে পুনর্বিন্যাস করলেই চলে। এ পরিবর্তন করাটাকেই আমরা সংবিধানের সংস্কার বলি। এটাই এখানকার মানুষের সমস্যা সমাধানের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে কী কী গুরুতর ত্রুটি আছে, যেগুলো রাষ্ট্র-চরিত্রকে স্বৈরাচারী ও গণবিরোধী করে তুলছে বারবার?
হাসনাত কাইয়ুম: আপাতত তিনটা বিষয় নিয়ে কথা বলা যায়। কেউ স্বৈরতন্ত্রী মানে, তাঁর ইচ্ছাই তন্ত্র, তিনি যা মনস্থ করেন তা-ই করতে পারেন, আইন-কানুন তেমন করেই তৈরি হয় বা থাকে, তাঁকে কৃতকর্মের জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। সারা পৃথিবীতে যেসব দেশে ন্যূনতম গণতন্ত্র আছে, সেসব দেশে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের একটা পদ্ধতি থাকে, সেটা নির্বাচন। কিন্তু বাংলাদেশে যাতে নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হাতবদল হতে না পারে, সে ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবেই করা হয়েছে ১৯৭২ সাল থেকে।বিষয়টা এ রকম না যে সেটা এরশাদ ক্ষমতায় এসে করে দিয়েছেন। এটা সাংবিধানিক কাঠামোর মাধ্যমেই করা হয়েছে।
এ সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রধানমন্ত্রীকে ‘ইমপিচ’ বা অপসারণ করার কোনো ব্যবস্থা সংবিধানের কোথাও নেই। ৭০ অনুচ্ছেদে বরং উল্টোটা আছে, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধাচরণ করলে, বিরুদ্ধে ভোট দিলে, সেই ব্যক্তির সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে। এই যে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন—বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ বা সংসদ এবং প্রশাসন বা সরকার, এই তিনটাকে যখন একজনের ইচ্ছাধীন করা হয়, যেসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোও যখন বন্দী করা হয়, তখন এই ক্ষমতাই স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম দেয়, গণতন্ত্র বিকাশের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জবাবদিহিহীন, ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন সবকিছুই বাধা। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের ঊর্ধ্বে, সংবিধান তাঁর অধীনে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেউ সংবিধান বা আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না। থাকলে দেশে কোনো প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর হাতে যদি তিন ভাগের দুই ভাগ সংসদ সদস্য থাকেন, তাহলে তাঁর কতটা ক্ষমতা—সেটা তিনি নিজেও জানেন না। তাঁর যখন যেটা ইচ্ছে, তিনি তখন সেটা করতে পারবেন। এ ধরনের ক্ষমতাতন্ত্র কখনো গণতন্ত্রের সঙ্গে যেতে পারে না। এভাবে একজনের কাছে ক্ষমতা দেওয়া, যেটা ’৭২ সাল থেকে চলে আসছে, বাংলাদেশের রাজনীতির মূল সংকটের প্রাণভোমরা এটাই।