ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে 'স্বৈরাচার' সরকার পতনের এক মাস পূর্ণ হলো। রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। বিজয় হয় ছাত্র-জনতার।
দীর্ঘ ১৫ বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা 'স্বৈরাচার' সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এক নতুন আশার জন্ম নেয়। গঠিত হয় নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তী সামগ্রিক পরিস্থিতি, অন্তর্বর্তী সরকার, তাদের করণীয়, প্রায় এক মাস বয়সী এই সরকারের চ্যালেঞ্জ কিংবা ভ্রান্তি, দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের এক মাস হলো। এ আন্দোলনটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
আনু মুহাম্মদ: এই আন্দোলনের ফলাফলই এর গুরুত্ব দেখিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে গত ১৫ বছর ধরে একটিমাত্র শাসকগোষ্ঠী ছিল ক্ষমতায় যারা নির্বাচন কিংবা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য নির্যাতন কিংবা দমন-পীড়নসহ অনেক কিছু তারা করেছে। তারা মিডিয়াকে ভয়াবহভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আদালত অকার্যকর হয়ে গেছে। মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন কোনো কাজ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেরুদণ্ডহীন মাস্তানদের সমাবেশ তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে একটি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি করেছিল। দুর্নীতির কারণে একদিকে যেমন জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে, অন্যদিকে হাজারো কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর মধ্যেই বিভিন্ন ধরনের গোপন চুক্তি, মেগাপ্রকল্পের কারণে মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতা বাসা বেঁধেছিল।
সবশেষ ২০২৪ সালের প্রহসনের নির্বাচনের পর মানুষের মধ্যে একটি হতাশা তৈরি হয়, একটা জাতিগত ডিপ্রেশন তৈরি হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা মানুষের মধ্যে অসহায়ত্ব তৈরি করেছিল। আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি-জামায়াত জোটের অতীত মানুষ দেখেছে। জাতীয় পার্টিকেও তারা দেখেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা বেশি সুখকর ছিল না। এজন্য জনগণের মনে ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও গত ১৫ বছরের অন্যান্য আন্দোলনগুলো সরকার পতনের দিকে যায়নি। কিন্তু মানুষের মাঝে প্রশ্ন ছিল যে এগুলো কতদিন চলবে? স্বৈরাচারী ব্যবস্থা, মানুষকে অপমান, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা আর কতদিন চলবে?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে সরকার পতন আন্দোলনের দিকে গেল, তা কোনো পরিকল্পিত ঘটনা ছিল না। সমাজের মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে আন্দোলনে। শুধু এই সময়ের আন্দোলন দিয়েও এটাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এখানে মূল বিষয় হলো এর সূত্রপাত রাজনৈতিক নেতৃত্বে হয়নি। গণঅভ্যুত্থান তো আগেও দেখেছি। ১৯৬৯, ১৯৯০ এ গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। '৬৯ এ রাজনৈতিক দলগুলো যেমন—আওয়ামী লীগ, ভাসানী ন্যাপ সামনে ছিল। এই আন্দোলনের ফল মুক্তিযুদ্ধ। আরেকটা গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল ১৯৯০ সালে এরশাদ পতন আন্দোলন। তখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামদলের নেতৃত্বে তিনটি রাজনৈতিক জোটের সম্মিলিত আন্দোলন হয়। এবারের জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না, এর কোনো নির্দিষ্ট নেতা ছিল না। কিন্তু যার বিরুদ্ধে আন্দোলন, সেই শেখ হাসিনা আন্দোলন দমাতে গিয়ে যা যা করলেন, তার সবই এটাকে সরকার পতন আন্দোলনের দিকে নিয়ে গেছে।
কোটা বাতিলের পরিপত্র আদালত বাতিল করে দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হলো। তাদের অনেকে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছিল। তারা আবার একটা অনিশ্চয়তায় পড়ল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোটা সংস্কার আন্দোলন আবার শুরু হয়। প্রথম থেকেই শান্তিপূর্ণ হওয়ায় জনগণের সমর্থন পায়। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর শান্তিপূর্ণ মিছিলে বা সমাবেশে ছাত্রলীগ, যুবলীগ আক্রমণ করল, মেয়েদের ওপর আক্রমণ করা হলো, এরপর আন্দোলনকে অবজ্ঞা করে শেখ হাসিনা বক্তব্য দিলেন, তারপর আবার পুলিশ, র্যাব শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করল, এসব মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলল। তারপর ১৬ জুলাই আবু সাঈদসহ সাতজন যখন নিহত হলো, তখন মানুষের প্রতিক্রিয়া এমন হলো যে আর কত সহ্য করা যায়? আবু সাঈদের ওপর যেভাবে গুলি হয়েছে এর তো কোনোভাবেই যৌক্তিকতা নেই। এর প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষ সমর্থন দিলো আন্দোলনে। একপর্যায়ে পাবলিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা যখন কুলাতে পারছিল না, তখন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা এলো, যেটা ছিল সরকারের ধারণার বাইরে। পরে কলেজের শিক্ষার্থীরা, স্কুলের শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত আন্দোলনে যোগ দিলো, পুরো দেশে ছড়িয়ে গেল আন্দোলন।