বিশ্ববিদ্যালয় হলো গবেষণা, শিক্ষা এবং সার্বিক অর্থে জাতি গঠনের স্থান। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ ধারা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছিলেন সরকারের ‘একান্ত অনুগত ভৃত্য’। রাজনীতি তো দূরের কথা, বিবেকের স্বাধীনতা থেকেও তারা বঞ্চিত ছিলেন। তাই, ১৯৭৩ সালে প্রণীত অধ্যাদেশ ছিল কাঙ্ক্ষিত ও প্রয়োজনীয়। দেশে তখন ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। চারটি সাধারণ আর দুটি বিশেষায়িত। বর্তমানে দেশে তিন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেমন সরকারি (৫৫টি)-প্রধানত সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত; বেসরকারি (১১৪টি)-এখানে কোনো সরকারি অর্থ দেওয়া হয় না এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় (৪টি) যা আন্তর্জাতিক সংগঠন কর্তৃক পরিচালিত। ১৯৭৩ সালের আইনটি বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য নয়, শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। অনুষদগুলোর ডিন নির্বাচন এবং বিভাগীয় সভাপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে এর কার্যক্রম থাকলেও আইন অনুযায়ী সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নির্বাচনের যে বিধি ছিল সে বিধি প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে। বিধি অনুযায়ী প্রতি চার বছর পর সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নির্বাচিত হওয়ার কথা। গত কয়েক দশক ধরে সিনেট থেকে মনোনীত ব্যক্তিদের উপাচার্য নিয়োগের সংস্কৃতি নেই বললেই চলে। তাছাড়া অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট নির্বাচনই হয় না।
ফলে বিভিন্ন কৌশলে লাল, নীল, সাদা, গোলাপি, বেগুনি এবং হলুদ দলের বলিষ্ঠ শিক্ষক নেতারা এ ক্ষমতার আসনে নিয়োগ পেয়ে সীমাহীন দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। অনিয়ম-অন্যায়ের অভিযোগে এ পর্যন্ত কোনো উপাচার্যকে ফৌজদারি আদালতের দ্বারস্থ বা কৈফিয়ৎ দিতে হয়নি। তবে অনেক ক্ষেত্রে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে বিদায় নিতে দেখা গেছে। বাস্তবে দলীয় উপাচার্যরা নিজেদের চেয়ার ধরে রাখার জন্য সরকারকে খুশি করতে ব্যস্ত থাকতেন। তাছাড়া প্রভাবশালী শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ করে দেন, যাদের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে তাদের অযোগ্য ছেলে, মেয়ে ও জামাতাকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একজন নতুন প্রার্থী প্রভাষক হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বাধ্যতামূলকভাবে ক্ষমতাসীন দলের রেজিস্টারে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছে। শিক্ষকরাও রংধনুর বিভিন্ন রঙে বিভক্ত। অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে সময়মতো পাঠদান ও গবেষণার পরিবর্তে দলীয় কার্যালয়ে বেশি সময় কাটান। তাতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক শিক্ষক উপাচার্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই বিভিন্ন পর্ষদে একের পর এক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। দেখলে মনে হয় শুধু রাজনীতি করার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান। তাছাড়া উপাচার্য হওয়ার মানদণ্ড হিসাবে শিক্ষক সমিতির সভাপতি-সেক্রেটারি পদগুলোও বিবেচ্য বিষয়। এগুলোই ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশের অধীনে থাকা ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সংকট। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২৭ জন উপাচার্য, ১২ জন উপ-উপাচার্য ও ৭ জন কোষাধ্যক্ষ পদত্যাগ করায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় একটি পবিত্র স্থান। উপাচার্য একটি সম্মানিত পদ। শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমরা চাইব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সত্যিকারের শিক্ষানুরাগী ও যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা আসুক’। স্যার একজন জ্ঞানী-গুণী ও আদর্শ শিক্ষক হিসাবে সবার কাছে পরিচিত। তিনি তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যোগ্য ও দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দেবেন, এটাই সবার প্রত্যাশা। তদবির ও নাম বাছাইয়ের সমস্যা এড়াতে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা, বয়স, অনার্স ও মাস্টার্সের ফলাফল, উপমহাদেশের বাইরের কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি, গবেষণার অভিজ্ঞতা এবং বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে কথা বলার দক্ষ ব্যক্তিদের বিবেচনা করতে পারেন।
ইতোমধ্যে আমাদের শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য এবং দুজন উপ-উপাচার্য নিয়োগদান করেছেন। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও আমরা দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ আশা করতে পারি। তবে অতি অল্প সময়ে যোগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ প্রসঙ্গে ড. মো. মুনিবুর রহমান উল্লেখ করেছেন, ‘উপাচার্য নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা যেতে পারে’, যেখানে প্রার্থীর যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ থাকবে। সার্চ কমিটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আলাদা শর্ট লিস্ট তৈরি করে দেবেন, তা থেকে যোগ্য ব্যক্তিদের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দেওয়া সহজ হতে পারে।
শিক্ষা উপদেষ্টা নিজেই একজন শিক্ষক। স্যারকে জ্ঞান দেওয়ার দুঃসাহস আমার নেই, তবুও আমার অভিজ্ঞতার আলোকে একটা অনুরোধ রাখতে চাই, তা হলো যারা উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগ পাবেন তারা যেন ওই পদে থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বসবাস করতে বাধ্য থাকেন। নিয়োগপত্রেও শর্ত হিসাবে তা উল্লেখ থাকা দরকার। অতীতে অনেক উপাচার্য কর্মস্থলের বাসায় বা ক্যাম্পাসে সার্বক্ষণিক অবস্থান না করে ঢাকায় বা নিকটস্থ শহরে বসবাসের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। আমরা এসবের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। উদাহরণস্বরূপ ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২-এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেসাকার (উপাচার্যের বাসভবনসহ ৫০টি বাস ভাঙচুর) ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই রাতে রক্তাক্ত শিক্ষার্থীদের বীভৎস ছবি দেখে এবং মারা যাওয়ার গুজবে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। ওই সময়ে উপাচার্য, প্রক্টর, আবাসিক হলের প্রভোস্টরা শহরে বসবাস করায় যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে পারেননি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়কে এত বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
উপাচার্য হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অভিভাবক এবং তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি আমাদের কাম্য। তাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উপাচার্যের মতবিনিময় এবং যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ বাড়বে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ব্যয়ও অনেকাংশে কমে আসবে।