এই বাংলাদেশ খুব সুন্দর। যে বাংলাদেশের তারুণ্য জেগে ওঠে, কিশোরেরা জেগে থাকে! সেই যে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা থেকে বারবার করে লিখছিলাম এই কলামে:
শিশুটি কোথায় গেল?...
সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক:
রাজা, তোর কাপড় কোথায়?
সেই শিশু এল, একজন নয়, দুজন নয়, এল লাখে লাখে, কোটিতে কোটিতে, এসে বলল, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’। ‘কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’। স্বৈরাচার কথাটা, আমরা বড়রা, মুখ ফুটে লিখতে পারিনি। শিশুরা, কিশোরেরা, তরুণেরা বলল। শুধু বলল না, তারা নয় দফাকে নিয়ে গেল এক দফায়। গুলি হলো। অঝোর ধারার বৃষ্টির মতো গুলি। লাঠিসোঁটা-কিরিচ-রামদা–অস্ত্রধারী হেলমেটধারীরা নেমে এল। কিন্তু যারা কথা দিয়েছিল আগামী ফাগুনে আমরা দ্বিগুণ হব, তারা এক সপ্তাহেই বহুগুণ হয়ে ফিরে এল। সাহসিকতার একেকটা মহাকাব্য রচিত হতে লাগল ঘরে ঘরে, রাজপথে রাজপথে। গ্রেপ্তার হয়েছে ছেলে, মা তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলছেন, শাবাশ, শাবাশ।
আবু সাঈদের সেই যে ১৯৬৯ সালের শহীদ অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে স্মরণ, মুগ্ধর ‘পানি লাগবে পানি’ থেকে ‘মা, যদি আমি শহীদ হই, আমার লাশ রাজপথ থেকে ততক্ষণ সরাবে না যতক্ষণ না বিজয় আসে’। বীরত্বের কী যে অপরূপ কাহিনি একেকটা। পুলিশ সদস্যের নিজের ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ। বাবা বলছেন বড় কর্তাকে, স্যার, একটা বাচ্চা ছেলেকে খুন করতে কয়টা গুলির দরকার হয়! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পুলিশ কর্তা বলছেন, একটারে গুলি করি, সেইডা পড়ে যায়, বাকি কেউ সরে না, এইটাই ভয় স্যার।
এত সাহস! এত বীরত্ব! এত আত্মত্যাগ। কী পাগলপারা, মাটিকামড়ানো লড়াই।
শিক্ষকেরা নেমে এলেন রাজপথে, মায়েরা এলেন, বাবারা এলেন। মন্ত্রীর ছেলে রাস্তায় ছুটে যাচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধার ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে, স্কুলের ছেলেমেয়েরা ইউনিফরম পরে নেমেছে রাস্তায়। বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর। এত মৃত্যু, এত রক্ত—মহান মুক্তিযুদ্ধের ১৯৭১ বাদে কখনো দেখেনি কেউ।
এরপর এল আকস্মিক বন্যা। তখন বাংলাদেশ জেগে উঠল আরেকবার। যেমন ১৯৭০ সালের সাইক্লোন-জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ এক হয়ে গিয়েছিল, যেমন ১৯৮০-র দশকে জগন্নাথ হলের মিলনায়তনের ছাদ ধ্বসে পড়লে পুরো ঢাকা শহর এগিয়ে এসেছিল, যেমন ১৯৮৮-র বন্যার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে শুরু করে নাগরিক সমাবেশগুলো রাতদিন ত্রাণকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এবার তেমনি, তেমনি নয়, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি করে শিক্ষার্থীরা আর নাগরিক সমাজ এগিয়ে এসেছে বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। সেখানেও কত মর্মস্পর্শী গল্প তৈরি হচ্ছে, শিশু তার জমানো টাকা দিচ্ছে, ওমরাহ করতে যাওয়ার টাকা দিচ্ছে, প্রতিবন্ধী দিচ্ছেন, মৃত মায়ের মাটির ব্যাংক ভেঙে টাকা দান করতে গিয়ে কেঁদে ফেলছেন বয়স্ক সন্তান।
গত এক দশকে এই ব্যাপারটাই উঠে গিয়েছিল, যে কথাও বারবার লিখছিলাম। করোনার সময়ে, ডেঙ্গুর মোকাবিলায় সরকার একা কাজ করে, প্রশাসন একা, মানুষ নেই! মানুষের সঙ্গে সরকারের সংযোগটা একেবারেই কেটে গিয়েছিল। তখন লিখেছিলাম, ‘আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম, ‘আমাদের চিন্তার বিষয় এই যে, পূর্বে আমাদের যে একটি ব্যবস্থা ছিল, যাহাতে সমাজ অত্যন্ত সহজ নিয়মে আপনার সমস্ত অভাব আপনিই মিটাইয়া লইত—দেশে তাহার কি লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকিবে না?’
কারণ হিসেবে বলেছিলাম, আমাদের জনপ্রতিনিধিরা জনগণের নির্বাচিত নয়। লিখেছিলাম, ‘আবারও তারুণ্যকেই জেগে উঠতে বলব। কারণ তারা যদি জাগে, তাহলে বাংলাদেশ জাগবে। ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’ সেই তারুণ্য জেগেছে, স্লোগান দিয়েছে, জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে। এই বাংলাদেশ সুন্দরতর।
কিন্তু আমাদের ইতিহাসের ভেতরেই যে কত হিংসা-দ্বেষের উদাহরণ! রবীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছেন, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি। ডাকাত সন্দেহে, ছেলেধরা সন্দেহে, পকেটমার সন্দেহে জনতা যে কী হিংস্রভাবে মানুষ হত্যা করে, এগুলো আমাদের কালেই আমরা অনেক ঘটতে দেখি। এখনো জনপদে জনপদে মারাত্মক লাঠিসোঁটা-টেঁটার লড়াই হয়, প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে রক্তপাত ঘটে।