অর্থ উপদেষ্টাকে পারতেই হবে

যুগান্তর ড. আর এম দেবনাথ প্রকাশিত: ২৪ আগস্ট ২০২৪, ১১:১৫

স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা, আবেগ ও বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা। এ এক সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি। নতুন সরকার। মানুষের চোখে-মুখে আশা-আকাঙ্ক্ষার ছবি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা দেওয়ালে দেওয়ালে গ্রাফিতি এঁকে যাচ্ছে। ইংরেজি ও বাংলায়। এর আগে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় সুন্দর সুন্দর ইংরেজি স্লোগান শুনেছি-বাংলা ব্লকেড, কমপ্লিট শাটডাউন, মার্চ ফর জাস্টিস, রিমেমবারিং আওয়ার হিরোস। কত সৃজনশীল স্লোগান! হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর মুখে, মানুষের মুখে। ‘বৈষম্য’ চাই না। শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের নাম হলো কোটাবিরোধী আন্দোলনের স্থলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। জনতা, ছাত্রছাত্রীদের চোখে-মুখে আগুন লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে।


এসব দেখে-শুনে আমার মনে পড়ে গেল ১৯৬৯-৭০, ১৯৭১ সালের কথা। গণ-অভ্যুত্থানের কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা। এখনকার তরুণদের মতোই তখন আমার বয়স। ‘বৈষম্য’ তখন আমাদের বড় স্লোগান। মনে পড়ে ‘পূর্ব-বাংলা শ্মশান কেন’ পোস্টারের কথা। তাতে ছিল পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ছবি। আমরা তখন স্বপ্ন দেখছি দেশ স্বাধীন হবে, বৈষম্য দূর হবে, দারিদ্র্য দূর হবে, কর্মসংস্থান হবে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসবে। মানুষে-মানুষে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সমান নাগরিক। বাঙালির দেশ বাঙালি চালাবে। অফুরন্ত সম্ভাবনার দেশ হবে বাংলাদেশ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা-এগারো দফার আন্দোলন হয়ে দাঁড়াল এক দফার আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। পাকিস্তানিরা নির্বাচনের ফল মানেনি। বাঙালিকে সরকার গঠন করতে দেয়নি। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ৯ মাসের যুদ্ধ। এক কোটি শরণার্থী প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নেন। ৩০ লাখ বাঙালি শহিদ হন। তিন লাখ মা-বোন নির্যাতিত হন। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের স্বাধীনতা। স্বপ্নময় স্বাধীন বাংলাদেশ। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তা আমাদের সংবিধানের চার স্তম্ভ। তরুণরা পারলে তখনই সমাজতন্ত্র কায়েম করে ফেলে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা কায়েম করে ফেলে। চারদিকে বাঙালির বীরগাথা। সবকিছু বদলে ফেলতে হবে। সংস্কার চাই সর্বত্র। পুরোনো কিছুই রাখা যাবে না। ঘুস-দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হবে। সর্বত্র সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।



আজকের তরুণ-তরুণীদের কর্মকাণ্ড দেখে, স্লোগান শুনে, ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা দেখে আমার সেই ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের কথা মনে পড়ছে। আর ভাবছি, পারবে তো তারা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে? পারবে তো রাষ্ট্রের ‘সংস্কার’ করতে? পারবে তো আমাদের একটু শান্তি, স্বস্তি দিতে? ঘুস-দুর্নীতি বন্ধ করতে পারবে তারা? অর্থ পাচার বন্ধ হবে তো? মূল্যস্ফীতি রোধ হবে তো? অপচয় বন্ধ হবে তো? ৫০-৫২ বছরে যে আবর্জনা জমেছে, তা কি তারা দূর করতে পারবে? আবেগ যা চাইছে, যা স্বপ্ন আমাদের, তা কি পরিপূর্ণতা পাবে? শত শত প্রশ্ন। কেন? কারণ আজকের সত্তরোর্ধ প্রজন্ম, মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া খুব বেশি অবদান নেই। আমরা যা চেয়েছিলাম, তা করতে পারিনি। বরং করেছি উলটোটি। এ কারণেই বলছি, আমরা ২০২৪ সালে আবার স্বপ্ন, আবেগ ও বাস্তবতার মুখোমুখি।


আবেগ বলে, ঋণখেলাপিদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক। পারলে ফাঁসি দেওয়া হোক। আবেগ বলে, পাচারকৃত সব অর্থ উদ্ধার করে দেশে আনা হোক। পাচারকারীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। আর অন্যদিকে গেলাম না। এ দু-একটি ইস্যুতেই সীমাবদ্ধ থাকি। প্রশ্ন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি উপরিউক্ত এ দুটি সমস্যার সমাধান করতে পারবে? ধরা যাক বড় ঋণখেলাপিদের কথা। প্রচুর টাকা তাদের কাছে পাওনা। তারা ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয় না। পুরো ব্যাংক খাত তারা খালি করেছে। আশকারা পেতে পেতে তারা মাথায় উঠেছে। এখন কি তাদের মাথা নোয়ানোর ব্যবস্থা করা যাবে? খেলাপি টাকা কি আদায় করা যাবে? যাবে, একশবার তা করা যাবে। বলা হচ্ছিল, রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকলে সম্ভব। বর্তমান সরকার কোনো দলের সরকার নয়। কাজেই রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থাকার কোনো কারণ নেই। অতএব, তারা কি পারবেন একটা পথ ধরতে? ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের জনসাধারণের কাছে হেনস্তা করে তারা কি টাকা আদায় করতে পারবেন? খেলাপিদের বাড়ির সামনে ঢোল পিটিয়ে মানুষকে জানান দিতে পারবেন যে, এই লোক ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয় না? সবাই তাকে ঘৃণা করো। এটা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে পারবেন কি অর্থ উপদেষ্টা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিকে কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিতে? পারা উচিত, করা যায়। ১০-২০ হাজার টাকা আদায়ের জন্য গ্রামে গ্রামে কৃষকের কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নেওয়া হয়। এ আইনটির নাম ‘পাবলিক ডিমান্ডস রিকভারি অ্যাক্ট’। যদি এ আইনে তা করা যায়, তাহলে শত শত কোটি টাকা ঋণ খেলাপের জন্য অর্থঋণ আদালতের আইনে তাদের কোমরে দঁড়ি বাঁধা যাবে না কেন? আমরা কি তা পারব? আবেগ চায়-কিন্তু বাস্তবে কি এটি করে আমরা উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারব? হাজার হাজার ঋণের মামলা উচ্চতর আদালতে বিচারকের অভাবে পেন্ডিং পড়ে আছে। খেলাপিদের টাকা আছে। তারা নানাভাবে মামলা আটকে রাখছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি কমপক্ষে এক ডজন নতুন বেঞ্চ তৈরি করে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি করতে পারবে? পারবে কি ‘সামারি ট্রায়াল’ করে ছয় মাসের মধ্যে সব মামলা শেষ করতে?



আরেকটি পথ হচ্ছে গ্রামের বিচার। যেমন : গ্রামের বাজারে এক ব্যক্তিকে কয়েকজন পেটাচ্ছে। লোকজন দেখছে। পিটুনি খেয়ে লোকটি রাস্তায় পড়ে যায়। তখন কয়েকজন পিটুনিদাতাকে জিজ্ঞেস করে-কেন লোকটাকে মারছ তুমি? উত্তর, তার কাছে টাকা পাব; দেই দেব দিচ্ছি বলে ঘুরাচ্ছে বেশকিছু দিন ধরে। তখন সবাই আহত লোকটিকে জিজ্ঞেস করে, তুমি টাকা নিয়েছ? উত্তর-নিয়েছি। আবার জিজ্ঞাসা-পরিশোধ করো না কেন? তখন কাঁদো কাঁদো অবস্থায় লোকটি বলে, আজ যেভাবে মারধর করে টাকা ফেরত চাইছে, এভাবে তো আগে টাকা ফেরত চায়নি। ‘ভদ্রভাবে’ চেয়েছে। ভদ্রভাবে সময় নিয়েছি। এখন যেভাবে পিটুনি দিয়ে, রক্তাক্ত করে চাইছে-টাকা আমি কালই পরিশোধ করে দেব। প্রশ্ন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি পারবে এ ধরনের ব্যবস্থা করতে? পারবে কি ‘ঋণখেলাপি’কে ‘ক্রিমিনাল অপরাধ’ হিসাবে গণ্য করতে? এখন এটি সিভিল মামলা। এটা আর শেষ হতে চায় না। মানবাধিকার, আত্মপক্ষ সমর্থনের দাবি ইত্যাদি মেনে বিচার করা এক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কুখ্যাত ঋণ মামলা ‘হলমার্ক’। ১২ বছর আগে হলমার্কের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়। কিছুদিন আগে মাত্র একটি মামলার রায় হয়েছে। বাকি দশটি ঝুলছে। টাকা উদ্ধার? ৪০০-৪৫০ কোটি আদায় হয়েছে, যেখানে ৪ হাজার কোটি টাকা পাওনা সোনালী ব্যাংকের। মালিক জেলে। বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তি হয়েছে। এর মধ্যে কারখানা বন্ধ, শ্রমিক-কর্মচারীদের চাকরি গেছে। আমদানি-রপ্তানি বন্ধ। সরকারি রাজস্ব আদায় বন্ধ। কলকারখানার যন্ত্রপাতি কোথায়? জমির খবর কী? সমাধান কী? হয় বন্ধ কারখানা বিক্রি, না হয় লিজ, না হয় ইকোনমিক জোন করা। সবই বাস্তবায়ন করা কঠিন।


এই হচ্ছে বাস্তবতা। আবেগ বলেছিল, বিচার হোক। ঋণখেলাপি ও জালিয়াতির বিচার হয়েছে; কিন্তু টাকা আদায় হয়নি। হাজার হাজার লোকের চাকরি গেছে। এ অবস্থায় করণীয় কী? আমার জানা নেই করণীয় কী। তবে বুঝতে পারছি বাস্তবতা ও আবেগ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের কাজ দুটি বিপরীতমুখী। একদিকে ঋণখেলাপির বিচার, অপরদিকে কলকারখানা চালু রেখে লোকের কর্মসংস্থান ঠিক রাখা। কঠিন কাজ। একটা করলে আরেকটা হয় না। আমরা টাকা আদায় চাই, কারখানা চালু রাখতে চাই, খেলাপির বিচার চাই। এ অবস্থায় পথ কী?

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us