প্রথম আলো: দেশে একটা গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, অনেকে একে বিপ্লব বলছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে একধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা চলেছে। যেসব দাবি উঠছে, সেগুলোকে কতটা বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে?
মুশতাক খান: জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যা হয়েছে, তা একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যে রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থার পতন হলো, তা একধরনের স্বৈরাচারী, কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা ছিল। এর ভিত্তিই ছিল বিরোধী সব সংগঠন, সেটা ব্যাংকই হোক, কোম্পানি বা রাজনৈতিক দল হোক—এগুলো ভেঙে ফেলা, দুর্বল করা এবং ভেতর থেকে চূর্ণ করে দেওয়া। আর জনগণের মধ্যে একটা ভয় ছড়িয়ে দেওয়া যে আমার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে গায়েব হয়ে যাবে। ছাত্রদের আন্দোলন যখন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হলো, এটা উৎখাত হলো। এই সাফল্যের কারণ এর কোনো সংগঠিত ভিত্তি ছিল না। আওয়ামী লীগ চেষ্টা করেছিল গোলাগুলি করে ভয়টাকে পুনরুৎপাদিত করতে, কিন্তু তারা ব্যর্থ হলো।
যে শক্তি সরকারব্যবস্থাকে চূর্ণ করল, সেটি অসংগঠিত রাস্তার শক্তি। এরা কিন্তু আজীবন রাস্তায় থাকতে পারবে না। এখন আমাদের অর্জনগুলো বাস্তবমুখী করতে হলে নিয়মকানুনের মধ্যে আসতে হবে। পাশাপাশি সেই নিয়মগুলোকে কার্যকর ও সমর্থন করার মতো সংগঠন তৈরি করতে হবে। আমাদের ভালো নিয়মকানুন আছে। কিন্তু যারা ক্ষমতাশালী সংগঠন বা সংস্থা, তারা যদি এই নিয়মকানুন মানতে না চায় এবং তাদের ঠেকানোর মতো যদি কোনো পাল্টা সংগঠন না থাকে, তাহলে আইন যা–ই থাকুক, তা কার্যকর হবে না। আমাদের সেই পাল্টা শক্তি নেই। আওয়ামী লীগ সব পাল্টা শক্তি ভেঙে দিয়েছিল। সমাজে যেসব দাবি উঠছে বা যেসব অর্জন আমাদের হয়েছে, তা টেকসই করার জন্য এখন দরকার পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট।
প্রথম আলো: এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কীভাবে কাজ করবে? আমাদের দেশে বিভিন্ন শক্তি আছে, স্বার্থ আছে। রাজনীতির ভিন্নতা আছে। সে ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কীভাবে হতে পারে?
মুশতাক খান: আমি যেভাবে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দেখি, তা হচ্ছে সমাজের মধ্যে বিভিন্ন সংগঠিত শক্তি ও নিয়মকানুন। এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় বা সামঞ্জস্য থাকতে হবে। রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিশ্লেষণ আমি ১৯৮০–এর দশকে প্রবর্তন করি। একটা দেশে কোন আইন কার্যকর হবে এবং সমাজে কী ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে, তা বোঝার জন্য সমান্তরালভাবে দেখতে হবে দেশটিতে সংগঠিত সংগঠনগুলো কারা। আমরা বাংলায় সব কটিকে প্রতিষ্ঠান বলি। আমাদের ইনস্টিটিউশন ও অর্গানাইজেশনকে আলাদাভাবে দেখতে হবে। রুলস অব দ্য গেম হলো ইনস্টিটিউশন। অন্যদিকে অর্গানাইজেশন হচ্ছে সংস্থা—রাজনৈতিক দল, ইউনিভার্সিটি, কোম্পানি কিংবা একটা ব্যাংক। নিয়মকানুন এসব সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যারা বা যে সংস্থা ক্ষমতাসীন, তারা নিয়ম মানতে চায় না। যারা ক্ষমতাবান, তারা পুলিশ কিনে নেবে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিনে নেবে, নির্বাচন কমিশন কিনে নেবে। কিনতে না পারলে ভয় দেখাবে। আপনাকে যা করতে হবে, সমান্তরাল কিছু সংগঠন তৈরি করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলছি, কেবল একটা কোম্পানি পণ্য আমদানি করবে, এমন নয়। একসঙ্গে যদি ৫০টি কোম্পানি পণ্য আমদানি করে, তাহলে একজন আইন না মানলে অন্যরা প্রতিবাদ করবে।
গত ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসন আমাদের সব সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়, ট্রেড ইউনিয়ন, কোম্পানি, ব্যাংক—কিছুই অবশিষ্ট নেই। সুতরাং আপনি এখন যত সুন্দর আইনই করেন না কেন, তা কাজ করবে না। তবে হতাশ হলে চলবে না। আমাদের একদিকে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে হবে, অন্যদিকে সংগঠনও তৈরি করতে হবে। তবে খুব দ্রুত সবকিছু কাজ করবে না। কোনো কোনো সংগঠন দ্রুত তৈরি করা যাবে, কোনো কোনোটি তৈরি করতে পাঁচ-ছয় বছর লেগে যাবে। রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রায়োগিক দিক এটাই। কালকেই যদি আমরা নরওয়ের মতো দেশ হতে চাই, তাহলে সব ধসে যাবে। তখন পুরোনো শক্তি বলবে, দেখো ওরা পারে না, আমরাই পারি। পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট হলো ক্ষমতার বিন্যাসের সঙ্গে আইনের সামঞ্জস্য। রাজনৈতিক বন্দোবস্ত মানে এই না যে সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটা রুমে আলোচনা করলাম যে কোনো বিষয়ে আমরা সবাই একমত।