নদী আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের শারীরবৃত্তীয় ও মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতার জন্যও নদীর ভূমিকা অপরিসীম। নদ-নদীর মনোমুগ্ধকর নৈসর্গিক সৌন্দর্য আমাদের সুস্থ রাখে। আবার নদ-নদীর দৃশ্যমান দখল ও দূষণ আমাদের মানসিক কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা চাই নদীর চলার অধিকার নদীকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। উন্নয়নের নামে নদীর অপরিণামদর্শী দখল আর দেখতে চাই না। পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান জরুরি।
বাংলাদেশে নদী দখল একটি গুরুতর সমস্যা, যা পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সামাজিক জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। বিভিন্ন স্থানে নদী দখল করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে, যা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। এ কথা কারোরই অজানা নেই যে, বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদ কীভাবে দখলদারদের কবলে পড়েছে। নদীর দুই পাশে নির্মিত ভবন, ইটভাটা ও শিল্পকারখানার কারণে নদীগুলো প্রবাহ হারিয়েছে, পানি দূষিত হয়েছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই নদীগুলো তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়েছে। আমাদের সবারই জানা, কোন কোন ক্ষমতাবান, কোন কোন শাসনামলে নদীগুলোকে তাদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য হত্যা করেছে। রিভারাইন পিপলসহ অন্যান্য পরিবেশবাদী সংগঠন এ বিষয়ে যে কথা বলেনি, তা কিন্তু নয়। সেমিনার, সভা, সিম্পোজিয়াম এবং নদী দিবস পালনের মাধ্যমে শাসকশ্রেণিকে বারবার দেশের নদীকে বাঁচানোর জন্য আকুল আবেদন জানানো হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আমাদের চোখের সামনে এরূপ দখল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হলেও শাসকরা কেউ এ বিষয়ে কর্ণপাত করেনি।
বাংলাদেশের কৃষির মেরুদণ্ড হলো নদ-নদী। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ দেশের সব নদীর পানি বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বর্ষা মৌসুমেও নদ-নদী প্রাকৃতিকভাবে পানির আধার হিসেবে কাজ করে এবং বন্যার তীব্রতাকে সহ্যসীমায় নিয়ে আসে। আবার পলি বয়ে নিয়ে আসার মাধ্যমে কৃষিজমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। নদ-নদীর আরেকটি অবদান হলো মৎস্য সম্পদ। ইলিশ, চিংড়িসহ মিঠাপানির মাছ উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের একটি বিশেষ পরিচয় রয়েছে। মাছের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করার মাধ্যমে শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনই না; এই খাতে বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী জীবিকা নির্বাহে জড়িয়ে রয়েছে।
পণ্য পরিবহনের জন্য নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রশ্নাতীতভাবে নদীর মাধ্যমে পণ্য পরিবহন অধিকতর সহজ, সাশ্রয়ী এবং দ্রুততর। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বড় সব শহর যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জ নদীপথের মাধ্যমে সংযুক্ত, যা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী নদী-পর্যটনের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশও এই অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে। বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগের অন্যতম উপায় হতে পারে নদী ভ্রমণ। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, বেশির ভাগ ভ্রমণপিপাসু বা পর্যটকের জন্য নদী ভ্রমণই অধিকতর উপভোগ্য, আকর্ষণীয় ও আরামদায়ক। নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবন-জীবিকা, সাংস্কৃতিক জীবনধারা, জলাভূমির নির্মল সৌন্দর্য, প্লাবনভূমি, পাহাড় অথবা বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর অপরূপ ভৌগোলিক অবকাঠামো তাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকাই স্বাভাবিক। উদাহরণ হিসেবে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলখ্যাত সুন্দরবনের নদীগুলো এবং দেশের দক্ষিণ-পূর্ব এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বহমান নদীগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলা যায়। এদিক থেকে বাংলাদেশের প্রতিটি নদী পর্যটন খাতের জন্য সুবর্ণ সুযোগ। দুর্ভাগ্যবশত নদী-পর্যটনের এই দ্বার উন্মোচন করতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। অথচ নদী-পর্যটনের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে আমরা নদীকে যেমন রক্ষা করতে পারতাম, তেমনি নদী-পর্যটন শিল্পে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হতো।
যা হোক, নদীগুলোকে রক্ষা এবং এর গুরুত্ব অনুধাবনের পাশাপাশি নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি। দেশের ভেতরে ছাড়াও আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ফোরামে আলোচনা, পরিকল্পনা, নীতিনির্ধারণ ও সমঝোতা চুক্তি করা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনার কথা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলেও বাস্তবিকভাবে কী হয়েছে, তা সাধারণ জনগণ জানতে পারেনি। অনেকের ধারণা, বিগত সরকারগুলোর ভারতকেন্দ্রিক নতজানু বৈদেশিক নীতির কারণেই আমরা নৈতিক হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়েছি এবং হচ্ছি।
এ জন্য আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালিত বাংলাদেশে চলমান সংস্কারের মধ্যে দেশের নদীগুলোকে রক্ষা এবং দখলমুক্ত করার প্রত্যয় যুক্ত হোক। নদী দখল রোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সচেতনতা বৃদ্ধি, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং জনসাধারণ বিশেষ করে তরুণ সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যেন নদীগুলোকে প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় এবং দেশের টেকসই পরিবেশ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়। এমন উদ্যোগ গ্রহণ ও কার্যকরভাবে প্রয়োগ করার জন্য নদী এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোরও এগিয়ে আশা দরকার। শুধু সরকার না; দেশের আপামর জনসাধারণ নদী রক্ষার এই মহতী উদ্যোগে অংশগ্রহণ করুক এবং উন্নত বাংলাদেশ গড়ার মতো অভাবনীয় কর্মকাণ্ডে অবদান রাখুক।