আবুল কাসেম ফজলুল হক শিক্ষাবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং আহমদ শরীফ চেয়ার অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো—মুক্তিসংগ্রাম, কালের যাত্রার ধ্বনি, নৈতিক চেতনা: ধর্ম ও মতাদর্শ, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন, উনিশ শতকের মধ্যশ্রেণি ও বাঙলা সাহিত্য প্রভৃতি। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার সঙ্গে।
এবারের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কীভাবে দেখেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: কোটা সংস্কারের প্রশ্নে ছাত্রদের আন্দোলন সাম্প্রতিক নয়; অনেক বছর আগে থেকে আরম্ভ হয়েছে। ২০১৮ সালে সরকার কোটা সংস্কার করার নীতি ঘোষণা করেছিল। সেটা নিয়েও সবাই সন্তুষ্ট ছিল না। তখন একপক্ষ সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে আবেদনও করেছিল। হাইকোর্টে মুক্তিযোদ্ধা কোটার পক্ষে একটি রিটও করা হয়। সেখানে তারা কোটার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে আবেদন জানায়। সে ব্যাপারে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
আন্দোলন চলাকালেই সংবাদ সম্মেলনে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক মন্তব্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচণ্ড অসন্তোষ দেখা দেয়। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ করে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন মাঠে নেমে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায় এবং গোটা দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এতে কয়েক শ মূল্যবান প্রাণ ঝরে যায়।
যে ক্ষয়ক্ষতি মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে হয়েছে, এ রকম আগে কখনো হয়নি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীর অধিকাংশ জেলায় বিস্তর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত ক্ষতি আমাদের জাতির ও রাষ্ট্রের হয়েছে। যে বর্বর মানসিকতার প্রকাশ এরই মধ্যে ঘটেছে, তার জন্য আসলে কারা দায়ী—সে প্রশ্ন আমাদের তুলতে হবে।
আগের যেকোনো গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে এবারের গণ-অভ্যুত্থানের পার্থক্য হচ্ছে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্রসংগঠন ও রাজনৈতিক দল। এবারের গণ-অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল না। পাশাপাশি এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে অনেক শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসকসহ নানা পেশার মানুষ দাঁড়িয়েছেন।
আমরা দেখেছি, জনগণ যখন বিবেকবুদ্ধি দিয়ে সংঘবদ্ধ হয়েছে, তখন সেই শক্তির সামনে কোথাও কোনো অত্যাচারী শাসক টিকতে পারেনি। কেননা, জনগণ পারমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী। জনগণ জাগলে কোনো অপশক্তিই তাকে পরাজিত করতে পারে না।
দেশে বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: শুধু কোটার ইস্যুতে আন্দোলন শুরু হলেও পরে সেটিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দীর্ঘদিন ধরে জিনিসপত্রের উচ্চমূল্য, অনেকটা একদলীয় কায়দায় জাতীয় নির্বাচন হওয়াসহ নানা কারণে মানুষের মাঝে ক্ষোভ জমে ছিল। অনেকে ভোট দিতে পারেননি। কোনোভাবেই ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু বিষয়। মানুষের মধ্যে ভয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ সরকারের প্রতি বিরূপ হয়েছিল। সেই অনাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দেশের জনগণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়। ছাত্র-জনতার বাঁধভাঙা জোয়ারে একসময় শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। পুলিশ এখনো পুরোপুরি তাদের দায়িত্বে ফেরেনি। ৮ আগস্ট রাতে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। একটু সময় লাগবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে।
সমাজে যখন মানবিক বোধ কমে যায় এবং নানা রকম অনাচার বাড়ে, সেই সমাজকে সুস্থ, স্বাভাবিক বলা যায় না। আমরা সে রকম একটা অসুস্থ সময় পার করছি। বিজ্ঞানের কল্যাণে অর্থনীতির ব্যাপক যে উন্নতি হয়েছে, সেখানে এখন পৃথিবীর যেখানেই হোক, খেয়ে-পরে বাঁচার মতো একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু মানবিক গুণাবলি ও মূল্যবোধ অনেকটাই লোপ পেয়েছে। উত্তরণ একেবারে হবে বলে মনে হয় না। পর্যায়ক্রমে সেটা হবে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এরপর সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করতে হবে।