মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের এ দেশটির জন্ম। মুক্তিযুদ্ধ যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন কৃষক, মাঝি, শ্রমিক, ছাত্র-যুবক, জেলে-তাঁতিসহ নানা পেশার মানুষ। তাঁরা সমাজের সাধারণ মানুষ ছিলেন। শত দুঃখ-কষ্টে থাকলেও সমাজের পরাধীনতাকে মেনে নিতে পারেননি। সৃজনশীল কোনো জাতি তা মেনে নিতে পারে না। এ ছাড়া প্রায় ৯৮ শতাংশ মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি না থেকেও নানাভাবে এই যুদ্ধকে সহযোগিতা করেছেন।
নানা লেখা, গবেষণা ও বক্তব্য থেকে আমরা বুঝতে পারি, সর্বোচ্চ সহনশীলতা, নমনীয়তার পরিচয় দিয়েছিলেন তাঁরা। পাকিস্তানিদের অযৌক্তিক আচরণ, অত্যাচারী মনোভাব, নির্মম হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে আমাদের পূর্বপুরুষেরা বাধ্য হন। তাঁরা ভেবেছিলেন, এই স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে দেশটির জন্ম হবে, সেখানে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম এক অনাবিল সময়ের মধ্য দিয়ে পথ চলবে। যেখানে রাগ-অভিমান থাকবে, বাদানুবাদ থাকবে, কিন্তু আলোচনার টেবিলে বসে তারা সমাধানে যাবে এবং সামনের দিকে এগোবে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে, শুধু পরস্পরের ভাষা বুঝতে পারার অক্ষমতা ও খণ্ডিত বাক্যাংশ ব্যবহার করে যে জটিলতা, যে সংঘর্ষ আমরা সৃষ্টি করেছি, তা মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নকেই অপমান করেছি, যাঁরা দেশটার আপামর মানুষের সুন্দর জীবনের কথা ভেবেছিলেন, নব প্রজন্মের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনেও তো সমাধান আলোচনায় হতে পারত। বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের অদ্ভুত নীরবতা, ফরমায়েশি বক্তব্য দেওয়ার মানসিকতা, এই বড় হয়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত সহনশীলতা ও মানবিকতাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। যার পরিণতিতে শত শত শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও পুলিশকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আসলেই আমরা অস্থির, অসহনশীল আর আক্রমণাত্মক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
মানুষ কেন এমন অনড়তা তৈরি করছে? কেন কেউ কারও কথা শুনতে চাচ্ছি না, বুঝতে চাচ্ছি না? সবাই তর্কে জিততে চাচ্ছি। আর মহা চোরেরা ক্রমেই চুরির পরিমাণ বাড়িয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে; এর কোনো সহজ উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে মস্তিষ্কের বিকাশ নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে, যা আমাদের জানায় এই রিজিডিটি, অসহযোগিতামূলক ও অনৈতিক আচরণের পেছনে কারণগুলো কী?
পৃথিবীর প্রাণের জন্ম অ্যামাইনো-অ্যাসিডের জটিল এক প্রকার অণু থেকে। এ অণুগুলো প্রথমে সরলপ্রাণ হয়ে এলোমেলোভাবে সংযোগে লিপ্ত হয়। শত শত কোটি বছর ধরে এই প্রাথমিক সরলপ্রাণ ক্রমেই উন্নত হতে থাকে। জটিল, বহুকোষী, মস্তিষ্কওলা প্রাণী হিসেবে রূপ নেওয়া পর্যন্ত এটা নিরন্তরভাবে চলতে থাকে। কেননা চারদিকের পরিবেশ-প্রকৃতি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হলে টিকে থাকার জন্য পূর্বনির্ধারিত জেনেটিক কোডও সামগ্রিকভাবে পর্যাপ্ত হয় না। এমনকি ৫০০ পৃষ্ঠার ১ হাজার খণ্ডের বইয়ের তথ্যসমৃদ্ধ জিন লাইব্রেরি, যা আগে টিকে থাকার জন্য সঠিকভাবে কার্যসম্পাদন করেছে, তা-ও ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। পরিবেশ পরিস্থিতির পরিবর্তন কোনো প্রাণীকে দীর্ঘ সময় ধরে অপরিবর্তিত অবস্থায় টিকে থাকার নিশ্চয়তা দেয় না। এই অসুবিধাগুলোর কারণেই আমাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটেছে। মাথায় রাখতে হবে সাংস্কৃতিকভাবে পরিবেশ পরিস্থিতি এর চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত পরিবর্তিত হয়।