সব ঘটনা ঘটে গেল দ্রুত। আমার তিনটি গণঅভ্যুত্থান দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। শৈশবে দেখেছি উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে একধরনের উপনিবেশের জীবন কাটাতে হচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শাসনে। তাই প্রতিবাদী বাঙালি প্রতিবাদ করছিল পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই। অধিকার আদায়ের আন্দোলন স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের দিকে চলে যায় বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আন্দোলনের তীব্রতা ভীত করে তোলে শাসকদের। তাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার নীলনকশা পাকা করে ফেলা হয়। বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার জন্য ছাত্ররা ১১ দফা নিয়ে রাজপথ মুখরিত করে। দ্রুতই গোটা পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে পড়ে। গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিতে থাকে। একসময় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ঢাকার রাজপথ জনসমুদ্রে পরিণত করে। সেই সমুদ্রে মহাপ্রতাপশালী আয়রনম্যানখ্যাত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ভেসে গিয়েছিলেন। বলা যায়, এ গণঅভ্যুত্থান সংঘটনে একটি দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পেরিয়ে আসতে হয়েছিল।
দ্বিতীয় গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে। দীর্ঘদিনের একনায়কতান্ত্রিক শাসনে মানুষ ক্ষুব্ধ হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তাতে বিস্ফোরণ ঘটে। ঢাকার রাজপথ আবার সয়লাব হয়ে যায় প্রতিবাদী মানুষে। গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে টিকে থাকতে পারেনি একনায়কতন্ত্র।
২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের চরিত্রটি এদিক থেকে অনেকটা আলাদা। ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন যে গণঅভ্যুত্থান ঘটাবে, তা ১৫ দিন আগেও ভাবা যায়নি। গণঅভ্যুত্থান ঘটার মতো প্রেক্ষাপটও তৈরি হয়নি। আন্দোলনের অনুঘটক ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। এ আন্দোলনকে সরকারপক্ষ নিয়মতান্ত্রিকভাবে মোকাবিলা করে সহজেই ফয়সালা করতে পারত। তেমনটি হলে গণঅভ্যুত্থান ঘটার প্রেক্ষাপটই রচিত হতো না। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রদের সহজ সমাধানযোগ্য আন্দোলনকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে না নিয়ে প্রথম একটি বড় ভুল করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, আন্দোলনকে শান্ত করার সহজ পথ হিসাবে আলোচনার বদলে ছাত্রলীগ আর পুলিশ দিয়ে তা দমন করতে গিয়ে ছাত্রদের ক্ষুব্ধ করে তোলেন। এ সময় থেকেই ক্ষুব্ধ ছাত্রদের আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সবচেয়ে অদূরদর্শী কাজ হলো, ছাত্র আন্দোলন দমন করতে পুলিশ-র্যাবের বল প্রয়োগ। পুলিশের গুলিতে অনেক ছাত্র-জনতা হতাহতের ঘটনা ঘটল। এমন রক্তাক্ত পরিণতি অগ্নিগর্ভ করে তোলে সমগ্র দেশকে। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার ছাত্রদের প্রধান সব দাবি মেনে নেয়। কিন্তু ততক্ষণে আন্দোলন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। ছাত্ররা এবার সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে চলে যায়। পরিস্থিতির বাস্তবতা বুঝে হাসিনা সরকার সহজ নিষ্ক্রমণের পথ বেছে নিতে পারত। কিন্তু সে পথে না গিয়ে হার্ডলাইনে চলে যায়। এতে আবার শতাধিক প্রাণ ঝড়ল। এরপর গণবিক্ষোভ আরও বাড়তে থাকল। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনেক অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষও যুক্ত হতে থাকল মিছিলে। অবস্থা আঁচ করতে পেরে শেখ হাসিনার মন্ত্রিপরিষদের কোনো কোনো মন্ত্রী ও নেতা-নেত্রী দেশ ছাড়তে লাগলেন। সবশেষে গণবিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় দেশত্যাগ করেন। এভাবেই গণঅভ্যুত্থানের পরিসমাপ্তি ঘটে।
আগেই বলেছি, আগের দুই গণঅভ্যুত্থানের চেয়ে চারিত্রিক দিক থেকে ২০২৪-এর ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান ছিল আলাদা। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ছিল পাকিস্তানি শাসকদের পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি সীমাহীন বৈষম্য ও নির্যাতনে বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ; যা রাজনীতিকরা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলতে পেরেছিলেন। একপর্যায়ে তা সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ক্ষুব্ধ করে পথে নামায়। ১৯৯০-এর আন্দোলনে ছাত্রদের নেতৃত্বই সামনে ছিল, তবে ধীরে ধীরে তা রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের সমন্বিত অংশগ্রহণে বিস্ফোরণ ঘটায়। কিন্তু এবারের গণঅভ্যুত্থান বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদেরই আন্দোলন। কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে শুরু হওয়া একটি আপাত নিরীহ আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেবে, তা সম্ভবত কোনো পক্ষই মনে করেনি। কারণ সচেতন অনেক মানুষই মনে করেছিলেন, আন্দোলন পল্লবিত হওয়ার আগেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের দায়িত্বশীল কেউ আন্দোলনকারী নেতাদের সঙ্গে বসে সমস্যাটির যৌক্তিক সমাধান করে দেবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু সে পথে হাঁটল না বিদায়ি সরকার। আমরা আমাদের লেখায় বিস্ময়ের সঙ্গে বলেছিলাম, আওয়ামী লীগের মতো মাঠের রাজনীতি করা দলের নেতারা শিক্ষার্থীদের সেন্টিমেন্ট বুঝবেন না, তা ভাবা যায় না। আসলে স্বৈরাচারী মনোভাব বড় হয়ে গেলে বুদ্ধির চোখে ছানি পড়ে। তাই পরিস্থিতিকে পাত্তাই দেননি তারা। একই সঙ্গে চলছিল শিক্ষকদের ‘প্রত্যয়’ পেনশনবিরোধী আন্দোলন। কোনোটাকেই পরোয়া করেননি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শিক্ষকদের প্রতি এমনিতেই তার কোনো শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। তিনি বলে দিলেন, ওরা আন্দোলন করে ক্লান্ত হোক আগে। শিক্ষকদের বিষয়টি না হয় বিশেষ কারণে মানা যায়। কারণ আমাদের শিক্ষক সমাজের রাজনীতি-সংযুক্ত শিক্ষকরা নানা রঙে রঞ্জিত। প্রধানমন্ত্রী জানতেন অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দলীয়ভাবে তার অনুগত। সুতরাং, এসব শিক্ষককে অত সম্মান দেওয়ার দরকার কী!