চলমান অস্থিরতা আর সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। দেশে কি বিদেশে। পরিবর্তিত এক অস্থির সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মানবসৃষ্ট প্রতিকূল পরিবেশের পাশাপাশি মোকাবিলা করতে হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিঘাতগুলোও। গত জুলাইয়ের প্রথম দিকে বন্যায় প্লাবিত হয় দেশের বেশ কিছু অঞ্চল। টানা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি। কিছুদিন ধরেই বন্যায় কৃষির ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে চ্যানেল আইয়ের সংবাদ প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে আসছিলাম।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অবস্থা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। চ্যানেল আইয়ের গাইবান্ধা প্রতিনিধি ফারুক হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, সেখানে দুই দফা বন্যায় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৭০ হাজারের মতো কৃষক। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় অন্তত ৭৬ কোটি টাকার ফসল ক্ষতি হয়েছে। ফারুক হোসেন সরেজমিনে দেখেছেন, জেলার নিম্নাঞ্চল এলাকার পাট, তিল, আউশ, ভুট্টা, চিনাবাদাম, আউশ, রোপা ধানের বীজতলা, কলা ও শাকসবজি বন্যার পানিতে দীর্ঘদিন তলিয়ে থাকায় নষ্ট হয়ে গেছে। গাইবান্ধার চরের মানুষের দুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। বন্যায় মরিচ, আমন ধানের বীজতলাসহ শাকসবজি তলিয়ে গেছে। দীর্ঘদিন পানি থাকার কারণে কোনো ফসলই আর টেকেনি।
উজানের ঢল এবং টানা বৃষ্টিতে জুলাইয়ের প্রথম দিকে সিরাজগঞ্জে বন্যা দেখা দেয়। সিরাজগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানায় ফেরদৌস রবিন। তিনি জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক বন্যায় জেলার প্রায় ৩৭ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রায় ৬০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এ কারণে অনেক কৃষক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অধিক বৃষ্টিতে যমুনা নদীতে পানি বাড়ার কারণে চর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এ সময় নদীতীরবর্তী সিরাজগঞ্জ সদর, কাজীপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলায় পাট, তিল, আউশ, আমন বীজতলা, সবজিসহ ৬ হাজার ৫২৫ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়। এর মধ্যে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায় ৩ হাজার ১৮৫ হেক্টর জমির ফসল।
সিলেট প্রতিনিধি সাদিকুর রহমান সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরাতে জানিয়েছেন, ওই জেলায় ১ হাজার ৪৭২ হেক্টর জমির আউশ ধান বন্যার পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ১৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আউশ ধানের ৬৯৪ হেক্টর বীজতলা। যার ক্ষতির পরিমাণ ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জমির শাকসবজি। যার ক্ষতির পরিমাণ ৭৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে কৃষকেরা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। কুড়িগ্রাম, বগুড়া, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জসহ আরও বেশ কয়েকটি জেলার বন্যা পরিস্থিতি একই রকম। এই অস্থির সময়ে কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। বন্যায় যে পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হয়েছে, হচ্ছে তা আমাদের জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। করোনার মতো জটিল সময়ে অনেক উন্নত দেশ যখন খাদ্যঘাটতির মধ্য দিয়ে গেছে, আমরা দরিদ্র দেশ হিসেবে খাদ্যঘাটতি সে রকমভাবে টের পাইনি। এর মূল কারণ সে সময় আমাদের কৃষক প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মাঠে ছিলেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়নি।
গত মাসে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) একটি সেমিনারে বক্তব্য রাখার সুযোগ হয়েছিল। সে সময় প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন জানিয়েছিলেন, তাঁদের জরিপ মতে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৫ শতাংশ। জরিপে দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মাছের দাম। এক বছরে মাছের দাম ২০ শতাংশের ওপর বেড়েছে। এরপর রয়েছে পোলট্রি মুরগির দাম। দেশের পোলট্রি খাদ্যের বড় অংশই আমদানিনির্ভর। করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে কয়েক বছরে আমদানি করা এসব খাবারের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে, যা শেষ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। এমন সময়ে দেশের খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হলে খাদ্যপণ্যের মূল্য পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।