একবার ফেসবুকের সুবাদে আমার হাতে একটি প্রেসক্রিপশন এসেছিল। তাতে এক পাস করা চিকিৎসক এক রোগীকে প্যাডের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বিশটি ওষুধ প্রেসক্রাইব করেছেন। এক ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রেসক্রিপশন দেখে মন্তব্য করেছেন-নিচে জায়গা থাকলে চিকিৎসক মশাই হয়তো আরও বিশটি ওষুধ লিখতেন। এক প্রেসক্রিপশনেই এত ওষুধ দেখে প্রথমেই আমার মনে হয়েছে-রোগী এত ওষুধ কখন খাবে? এতগুলো ওষুধ সময় করে খেতে শুরু করলে রোগীর যে সারা দিন সারা রাত কেটে যাবে।
প্রেসক্রিপশনে প্রদত্ত এত ওষুধ প্রয়োজনীয় নাকি অপ্রয়োজনীয় তার বিশ্লেষণ না হয় পরেই করলাম। একটিমাত্র প্রেসক্রিপশনে এত বেশিসংখ্যক ওষুধ লেখার বিষয়টি অবাস্তব মনে হলেও তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। এসব ওষুধের সিংহভাগই হলো ‘বাণিজ্যিক ওষুধ’, যার সঙ্গে রোগের কোনো সম্পর্ক নেই।
ওষুধের যুক্তিহীন ব্যবহার ও প্রয়োগ দেশের এক বড় সমস্যা। ওষুধ ব্যবহারের সমস্যা জানতে হলে; ওষুধের নিরাপদ, যুক্তিসংগত ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে সমস্যার উৎস, সমস্যা সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করা এবং তাদের মানসিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন অপরিহার্য। সমস্যা চিহ্নিত না হলে ওষুধের যুক্তিসংগত প্রয়োগ এবং এর প্রকৃত উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। দেশের ক্লিনিক, হেলথ কমপ্লেক্স বা হাসপাতালগুলো ওষুধের অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগের মূল উৎসগুলোর অন্যতম। অনিয়ন্ত্রিত ওষুধের ক্রয়-বিক্রয়ের কারণে ওষুধের অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগের দিক থেকে ড্রাগ স্টোরগুলোর অবস্থান বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে। ডিগ্রিধারী ফার্মাসিস্টের অভাবে এবং ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সাধারণত অজ্ঞ-অশিক্ষিত লোকজন দ্বারা ড্রাগ স্টোর পরিচালিত হয় অন্য ভোগ্যপণ্যের দোকানের মতো। কিন্তু ওষুধের দোকান আর মুদি দোকান বা কাপড়ের দোকান এক হতে পারে না। তবে ঘোষিত ওষুধনীতি ২০১৬তে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতি অন্তর্ভুক্তির কারণে ওষুধের অপব্যবহার কিছুটা হলেও কমে আসবে বলে আমার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
ওষুধের অযৌক্তিক প্রয়োগের বড় উৎস হলো চিকিৎসকের রোগ নির্ণয় ও প্রেসক্রিপশন। চিকিৎসক ঠিকমতো রোগ নির্ণয় করে যুক্তিসংগতভাবে ওষুধ প্রদান না করলে রোগী ওষুধের অপব্যবহারজনিত সমস্যার শিকার হবে। চিকিৎসক তার দায়িত্ব সঠিক ও নির্ভুলভাবে পালন করলেও ওষুধের ডিসপেনসিং যুক্তিসংগত বা সঠিক না হলে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে প্রেসক্রিপশনে প্রদত্ত ওষুধ সম্পর্কে রোগীকে পর্যাপ্ত ও প্রকৃত তথ্য, পরামর্শ বা উপদেশ প্রদান করা না হলে যুক্তিহীন ব্যবহারের কারণে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রোগীর জন্য প্রেসক্রিপশনে ওষুধ প্রদানে চিকিৎসক যত সতর্কতা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করবেন, রোগী তত বেশি উপকৃত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে পেশেন্ট কাউন্সেলিং বলে কিছু নেই। রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধে চিকিৎসকদের ভূমিকাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। আমাদের দেশে একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে। চিকিৎসক এলে ওষুধ ছাড়াই রোগীর অর্ধেক রোগ ভালো হয়ে যায়। এর পেছনে বৈজ্ঞানিক সত্য রয়েছে। কারণ রোগের ক্ষেত্রে অনেক সময় শরীর ও মনের যোগসূত্র অভিন্ন। উন্নত বিশ্বে প্রকৃত চিকিৎসা শুরুর আগেই চিকিৎসক প্রায়ই রোগীকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে চাঙা করার উদ্যোগ নেন। রোগীকে তার রোগ সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য প্রদান এবং চিকিৎসা সম্পর্কে অবহিত করতে চিকিৎসকরা সদা সচেষ্ট থাকেন। এতে রোগীর আস্থা ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। রোগীও সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তথ্য জানার জন্য চিকিৎসককে প্রশ্ন করার অধিকার রাখেন। ফলে রোগ নির্ণয় ও ওষুধ প্রয়োগে ভুল কম হয় বলে ওষুধের অপব্যবহারও কমে আসে।
তারপরও দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকরা তাদের প্রেসক্রিপশনে যেসব ওষুধ লিখে থাকেন, তার সব যুক্তিসংগতভাবে লেখেন না। ওষুধের এ অযৌক্তিক প্রয়োগের পেছনে বহুবিধ কারণ কাজ করে। বহু চিকিৎসক পেশাগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাবে রোগীকে সঠিক ওষুধ প্রদানে সক্ষম হন না। জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রগতি ও পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এসব চিকিৎসক নিজেদের যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন না। এসব চিকিৎসক সাধারণত সনাতনী পদ্ধতিতে যুগ যুগ সেকেলে মানসিকতা নিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যান বলে রোগ নির্ণয় বা ওষুধ প্রদানে প্রায়ই ভুল হয়। পৃথিবীজুড়েই বহু চিকিৎসক ওষুধ কোম্পানি কর্তৃক প্রভাবিত ও প্রলুব্ধ হয়ে অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর ও সস্তা ওষুধের পরিবর্তে দামি ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখে থাকেন। ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধ বাজারজাত করার পর সর্বশক্তি নিয়োগ করে থাকে তাদের ওষুধের কাটতি বাড়ানোর জন্য। চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানিগুলোর ইচ্ছা পূরণ করে প্রেসক্রিপশনে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় অসংখ্য ওষুধ লিখে থাকেন।
উন্নত ও অনুন্নত বিশ্বের ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদিত ওষুধের প্রমোশনে এবং পলিটিক্যাল লবিংয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে থাকে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই ব্যয়ভার বহন করতে হয় নিরীহ ক্রেতা বা রোগীকেই। ওষুধের কাটতি বাড়ানোর জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলোর মূল টার্গেট চিকিৎসক। কারণ চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনে যে ওষুধ লেখেন, রোগী মূলত সেই ওষুধই কিনে থাকে। অধিক মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে ওষুধ কোম্পানিগুলো সাধারণত টনিক, ভিটামিন, হজমিকারক, বলবৃদ্ধিকারক, এনজাইম, কফমিকচার, এলকালাইজারজাতীয় অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর ওষুধ উৎপাদনে বেশি তৎপর থাকে। ১৯৮২ সালের ওষুধনীতিতে নিষিদ্ধ গ্রাইপ ওয়াটার ও সিমিথিকনজাতীয় ওষুধও চিকিৎসকরা অবলীলায় লিখছেন এবং বাজারে বিক্রিও হচ্ছে। আমার প্রশ্ন, কী আছে এই গ্রাইপ ওয়াটারে এবং কী কারণে শিশুদের এসব জঞ্জাল প্রদান করা হচ্ছে?