একটা খেলার কথা খুব মনে পড়ে। খেলার শুরুতে জিজ্ঞাসা করা হতো, ‘আমি যা দেখি, তুমিও কি তা-ই দেখো?’ এখন সব সময় কেবল জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, ‘আমরা যা দেখি, আপনারাও কি তা-ই দেখেন?’
যেমন মনে করেন, আমি দেখলাম, একজন মানুষ রিকশা চালিয়ে যাওয়ার সময় কেউ তাকে ডাকল একটি গুলিবিদ্ধ মানুষকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য।
লোকটা রিকশা নিয়ে দ্রুত পৌঁছে দেখল গুলিবিদ্ধ মানুষটি আর কেউ নয়, তার নিজের কিশোর সন্তান!
তারপর মনে করেন, এক মা নির্লিপ্ত স্বরে বলছেন, বারবার জুতা-স্যান্ডেল হারানোর জন্য তাঁর ছেলেকে তিনি কতই–না বকতেন!
কিন্তু ছেলের গুলিবিদ্ধ লাশ যখন হাতে এল, দেখলেন নতুন জুতাজোড়া অক্ষত আছে, চকচকে একেবারে। মা নির্লিপ্ত স্বরেই বলে যান, ‘এবার কিন্তু সে জুতা হারায়নি।’
তাকিয়ে থাকলেই দেখতে হয়, দেখলাম, কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া ঠেকাতে জানালা বন্ধ করতে গিয়ে চাচার ঘাড়ে থাকা ভাতিজার মাথা ফুটো হয়ে গুলি দেয়ালে গর্ত করে ফেলেছে।
দেখলাম, বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই মায়ের শরীর ঢলে পড়েছে গুলির আঘাতে। কে জানত, সেটাই ছিল শিশুর শরীরে মায়ের শেষ স্পর্শ!
আচ্ছা, এসব কি আপনারাও দেখেন?
বিশ্বাস হয় না। কিছুতেই বিশ্বাস হয় না যে আপনারাও দেখেন। বিশ্বাস হয় না যে আপনারা আবু সাঈদের গুলি খাওয়ার দৃশ্যটা দেখেছেন।
বিশ্বাস হয় না যে ভিডিওতে আঁতকে ওঠা কণ্ঠটা শুনেছেন, ‘এই গুলি খাইছে রে, গুলি খাইছে!’
দেখলে কি অস্ত্র তাক করা পুলিশের জায়গায় একটা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া কিশোরকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হাতকড়া পরাতেন? ১২ দিন আটকে রাখতেন?
এফআইআরে লিখতেন সন্ত্রাসীদের ইটপাটকেলের আঘাতে আবু সাঈদের মৃত্যুর বয়ান? আপনারা নির্ঘাত দেখেন না। দেখাদেখির খেলায় আপনারা হেরে যাচ্ছেন।
দেখেননি, পুলিশ কী করে নির্মাণাধীন ভবনের গায়ে বাঁচার তাগিদে মাকড়সার মতো ঝুলে থাকা এক কিশোরকে গুলির পর গুলি করে।
দেখেননি, পুলিশ কী করে নির্যাতনের পরে অর্ধমৃত যুবককে দলামোচড়া করে গাড়ি থেকে পথে ফেলে দেয়, কী করে তাকে ধীরে ধীরে মরে যেতে হয়!
আপনারা একাত্তরে ছাত্রদের ওপরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার দেখেছেন বলে দাবি করেন, তার সঙ্গে আজকের দৃশ্যগুলোর মিল আমরা যেমন দেখি, আপনারাও কি দেখেন?
এ পর্যন্ত ১৩৭ জনের শরীরে প্রাণঘাতী গুলি পাওয়া গেছে। আমরা এই বাস্তবতা দেখি, আপনারাও কি দেখেন?