কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে দেশব্যাপী গণবিস্ফোরণ ছড়িয়ে পড়েছে। দেশ অভূতপূর্ব এক চরম সংকটকাল অতিক্রম করছে। সরকারের নিপীড়ন, নির্যাতন, হত্যা, গ্রেফতার ও শক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলন দমনের চেষ্টা যত বেড়েছে, আন্দোলন তত তীব্রতর হয়েছে। রাজনৈতিক কৌশলের কূটচালেও এ আন্দোলন দমিত হয়নি। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চলমান পরীক্ষা বন্ধ করে, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ রেখে, কারফিউ জারি, হেলিকপ্টার ব্যবহার এবং আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা করেও আন্দোলন দমানো যায়নি। আন্দোলনে সম্পৃক্ত শিশু, তরুণ, যুবকদের গ্রেফতার ও শতশত আন্দোলনকারীকে হত্যা ও নির্যাতন করলেও আন্দোলন স্তিমিত হয়নি। পরিবর্তে আন্দোলন তীব্র হয়েছে এবং এতে গণসম্পৃক্ততা বেড়েছে। আন্দোলনকারীদের সমর্থনে রাজপথে নেমেছেন শিক্ষক, সাংবাদিক, অভিনেতা, গায়ক, ডাক্তার, আইনজীবী, সাংবাদিক, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও বিভিন্ন পেশাজীবী। স্বৈরতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আন্দোলন দমনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আন্দোলনরত জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে আন্দোলনের ধারাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার উদ্যোগও সফল হয়নি।
বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। একই প্রক্রিয়ায় বর্তমানে কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে অধিকাংশ বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ওপর পোশাকধারী বাহিনী ও সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের সশস্ত্র আক্রমণ কাজে লাগেনি। নিরস্ত্র, নিরীহ শিক্ষার্থীদের পুলিশের গুলি করার দৃশ্য ইন্টারনেট খুলে দেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনরত ছাত্রসমাজ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। পরবর্তী সময়ে তারা নতুন উদ্যমে আন্দোলন এগিয়ে নিতে অব্যাহতভাবে কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছেন এবং ওই কর্মসূচিগুলোয় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এসব বিশ্লেষণের পর বলা যায়, আন্দোলনকারীরা তাদের আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তীব্রতর করতে পেরেছে। আন্দোলনের পক্ষে গণসম্পৃক্ততা বাড়াতে পেরেছে। পেরেছে স্বদেশি বিভিন্ন দলমত-পেশার বিবেকবান নাগরিক সমাজের এবং বহির্বিশ্বে জাতিসংঘসহ পরাশক্তিধর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সহানুভূতি ও সমর্থন অর্জন করতে। বলা যায়, আন্দোলনকারীরা আন্দোলনে এগিয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে, ক্রমান্বয়ে সরকার একঘরে হয়ে পড়ছে। ছোট হয়ে এসেছে সরকারি দলের সমর্থকদের পরিধি। কেবল সরকারদলীয় মন্ত্রী-এমপি এবং এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে এর দুর্বল সমর্থন সীমিত হয়ে পড়েছে। বিদেশি বাংলাদেশিদের মধ্যেও সরকারের সমর্থন নড়বড়ে। পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় বিরাজিত সরকারবিরোধী মনোভাব কোটা আন্দোলনের পর অধিকতর চাঙা হয়েছে। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় দেশগুলোয় সরকারের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি দুর্বলতর হয়েছে। এমন অবস্থায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসনিক কাজকর্ম ও শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে ধসে পড়েছে। বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরাও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সমর্থন জানিয়ে সমাবেশ করেছেন।
আন্দোলন দমনে সরকার শিক্ষার্থীদের ৮ দফা (পরবর্তীকালে ৯ দফা) দাবির প্রতিক্রিয়ায় বলেছিল, আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে সন্ত্রাস করছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হবে না। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হবে না। কিন্তু ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার পর সরকার সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ৬ সমন্বয়কারীকে ডিবি অফিস তুলে নিয়েছে। তাদের দিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা প্রদান করিয়েছে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। এরা একপর্যায়ে মুক্ত হয়ে আবারও আন্দোলন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
কোটা আন্দোলন যে কোটা সংস্কারের দাবিতে সীমিত নেই, সে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। আন্দোলনটি এখন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে। এ কারণে সরকার ও এর সহযোগী শরিক দলগুলো ছাড়া অন্যসব ডান, বাম দল এ আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে পাশাপাশি কর্মসূচি পালন করছে। উল্লেখ্য, এ সরকার সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে আদালতের দোহাই দিয়ে বিচারপতি খাইরুল হকের একটি খণ্ডিত ও বিতর্কিত রায়ের একাংশ ব্যবহার করে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী-এমপিরা ক্ষমতায় থেকে দলীয় ব্যবস্থাধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক ব্যবস্থা করে। রাজনৈতিক দলগুলো বুঝতে পারে, এমন ব্যবস্থাধীনে নির্বাচনে অংশ নিলে জনসমর্থন থাকলেও কোনো বিরোধী দল নির্বাচনে জিততে পারবে না। এ কারণে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পাশাপাশি অন্য গণতন্ত্রমনা ও বাম দলগুলোও সংসদ নির্বাচন বয়কট করে আসছে। ফলে দেশে গণতান্ত্রিকব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
জনগণ এসব বিষয় বুঝে ভোটকেন্দ্রমুখী হচ্ছেন না। ছাত্র-যুবকরাও বিষয়টি অবগত। তাদের একটি বড় অংশের বয়স ১৮ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। এরা অনেকে নতুন ভোটার হয়েও ভোট দিতে না পেরে ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেটবাজি রোধে সরকারি ব্যর্থতা, ছাত্রলীগের ক্যাম্পাসে দখলদারি ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও পোশাকধারী বাহিনীর নিপীড়ন, গায়েবি মামলায় তাদের গ্রেফতার, হয়রানি ও নির্যাতন এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করে দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয়দানের ঘটনা প্রত্যক্ষ করে ক্ষোভে ফুঁসছিলেন। এমন অবস্থায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হওয়ায় প্রথমে শিক্ষার্থী ও যুবসমাজ এবং পরে অন্য সব পেশাজীবী ও দেশপ্রেমিক নাগরিকরা এ আন্দোলনে যোগ দিয়ে আন্দোলনের গতি বাড়িয়েছেন। এ কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জনসমাগম হচ্ছে। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা তাদের ক্ষোভ প্রকাশে সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন।