সাম্প্রতিক সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশব্যাপী সৃষ্ট নজিরবিহীন পরিস্থিতিতে জাতীয় অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রায় সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় গণপরিবহণ, ইন্টারনেটসহ অনেক সেবা ও পরিষেবা। সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকাও থমকে যায়। বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষ ও দিনমজুররা সবচেয়ে সংকটে পড়ে। নিত্যপণ্যের বাজারে নানা ছুঁতোয় আগুন লাগানোর প্রবণতা রয়েছে, এ সংকটে নতুনভাবে আবারও আগুন লাগায় অসাধু ব্যবসায়ীরা। অনেক জায়গায় নিত্যপণ্যের বিপুল মজুত থাকলেও দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায়। যদিও নিত্যপণ্য পরিবহণে বড় ধরনের কোনো সংকট তৈরি হয়নি।
ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রবর্তনের দাবিটি জোরালো হয়েছে, যে বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে জাতির পিতার নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপুলসংখ্যক মানুষ শহিদ হয়েছিলেন। দেশে বৈষম্য প্রকট। ব্যাপক দুর্নীতির পাশাপাশি রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষ বৈষম্যের শিকার। এবারের ছাত্র আন্দোলনের কারণও ছিল সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য।
অস্থিরতা চলাকালে সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শীর্ষ ব্যবসায়ীদের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় ব্যবসায়ী নেতারা দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতের সমস্যা তুলে ধরেন। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও বৈদেশিক যোগাযোগে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরলেও ব্যবসার অন্যতম অনুষঙ্গ ভোক্তাদের কোনো সমস্যার কথা কেউ বলেননি অথবা এ সমস্যা উত্তরণে তাদের কী করণীয়, তা নিয়েও আলোচনা করেননি।
দেশের বাজার বিশ্লেষকসহ অনেক অর্থনীতিবিদ দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছিলেন, নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপনে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আমদানিকারক, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী সবাই লাগামহীনভাবে বাজারে সব পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। চাল, পেঁয়াজ, রসুন, আলু, মাছ-মাংস, সবজি ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই দায়ী। এদিকে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘিরে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিশেষত ডলার সংকটের এ সময়ে পণ্য আমদানি এখনো পর্যাপ্ত নয়। দেশে রেমিট্যান্সসহ বৈদেশিক মুদ্রার আয় না বাড়লে আমদানি আরও কমতে পারে, যার খেসারত দিতে হবে দেশের নিম্ন ও সীমিত আয়ের সিংহভাগ মানুষকে। জীবন-জীবিকা নির্বাহে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হবে তারা।
সরকার এবার নতুন করে দায়িত্বভার নেওয়ার সময় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখতে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও এক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি। ফলে নিত্যপণ্যের বাজার সেই আগের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। নানা অজুহাতে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। আর যারা এগুলো দেখভাল করার দায়িত্বে, তারা নানা রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যতিব্যস্ত। ফলে বেশ কয়েক বছর ধরেই সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে অসহনীয় জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। সরকারের (বিবিএস) তথ্যমতে, বিগত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে পাওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৪ কোটি ১০ লাখ পরিবারের ২৬ শতাংশ মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করে চলছে। এসব কারণে বিগত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরুর দিকে পণ্য পরিবহণ কিছুটা ব্যাহত হলেও পরে ডিজিটাল লেনদেন বন্ধ করে দেওয়ার কারণে দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য স্তিমিত হয়ে যায়। বৈদেশিক বাণিজ্য, বিশেষ করে রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পেও এর ধাক্কা লাগে। অনেক ক্রেতা তাদের আদেশকৃত পণ্য না পাওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যে নেতিবাচক পরিস্থিতির পাশাপাশি বাজার হারানোর শঙ্কায় আছেন রপ্তানিকারকরা। কৃষি উৎপাদন সচল থাকলেও কৃষিপণ্য পরিবহণে বাধার কারণে এ খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।