এ লেখাটি যখন তৈরি করছি, বাইরে তখন চতুর্থ দিনের কারফিউ চলছে। সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রাস্তায় রাস্তায় টহল দিচ্ছেন। কদিন আগের তুলনায় পরিস্থিতি শান্ত। সংঘাত-সংঘর্ষ একেবারেই নেই।
মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে স্বস্তি ফিরে আসছে। তবে সবাই উৎকণ্ঠিত আবার কখন পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ইন্টারনেট যোগাযোগ বন্ধ, নেই ফেসবুক-ইউটিউবের উৎপাত।কারও সঙ্গেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। বাসায় অলস সময় পার করতে হচ্ছে টেলিভিশনে খবর দেখে।
কেন এবং কী কারণে হঠাৎ করে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো, তা এখন কারও জানতে বাকি নেই। সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণ বা সংস্কার নিয়ে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন যখন সাধারণ মানুষের সমর্থন-সহানুভূতি পেতে শুরু করেছিল, তখনই তা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরীহ আন্দোলনে পক্ষভুক্ত হয়ে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরিস্থিতিকে সংঘাতের দিকে নিয়ে যায়। অপর একটি শক্তি নিবন্ধনহীন দল জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে ঘোষণা না দিলেও দলটির কর্মী-ক্যাডাররা অনুপ্রবেশ করেছিল এই ঘটনায়।
কোটাবিরোধী (পরে বলা হয়েছে সংস্কার) আন্দোলন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কথাবার্তার মধ্যে অনেকেই দায়িত্বশীলতার অভাব লক্ষ করেছেন। তিনি আন্দোলনের শুরু থেকেই বলছিলেন, এর পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন রয়েছে; যদিও তখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল আন্দোলনে পক্ষভুক্ত হয়নি। অনেকেই বলেছেন, ওবায়দুল কাদেরের কথায় মনে হয়েছে, তিনি বিরোধী দলকে ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য উসকে দিচ্ছেন। উপরন্তু তিনি যখন ছাত্রলীগকে মাঠে নামার কথা বললেন, তখনই সবাই শঙ্কিত হয়ে পড়েন আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে কি না, এই ভয়ে।
শাসক দলের এই অবস্থান বিএনপিকে উসকে দিল। তারা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তাদের ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সর্বাত্মক সমর্থন ও পরদিন থেকে মাঠে থাকার কথা জানাল। ছাত্রদলের ওই সংবাদ সম্মেলনে দলটির নেতা রুহুল কবির রিজভী উপস্থিত ছিলেন। ফলে কারও বুঝতে বাকি থাকেনি শীর্ষ নেতৃত্বের ইশারায়ই ছাত্রদল মাঠে নেমেছিল।
এক দিন পরেই বিএনপির মহাসচিব ছাত্রদের আন্দোলনে তাঁদের সমর্থন ব্যক্ত করার পাশাপাশি দেশবাসী সবাইকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানান। এরপরও তিনি বললেন, শিক্ষার্থীদের দাবি আদায় এবং সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আন্দোলন শিক্ষার্থীদের, আর তা কত দিন চলবে তার ঘোষণা দেন বিএনপির মহাসচিব। তা ছাড়া, কোটাসংক্রান্ত আন্দোলনের সঙ্গে সরকার পতনের কী সম্পর্ক আছে, তা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই ভালো বলতে পারবেন। একটি অরাজনৈতিক ইস্যুতে গড়ে ওঠা অহিংস ছাত্র আন্দোলনে এমন প্রকাশ্য সমর্থন সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলটির দায়িত্বশীলতার অভাব বলেই সচেতন ব্যক্তিরা মনে করেন।তবে কৌশলী ভূমিকা নিয়েছে জামায়াত। তাদের কর্মী-ক্যাডাররা আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করলেও প্রকাশ্যে কোনো ঘোষণা দেয়নি।
সরকারের অবজ্ঞা ও উদাসীনতা এবং বিরোধী দলের হঠকারিতা একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে কতটা সহিংস করে তুলতে পারে, সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার ছাত্র আন্দোলন তার উদাহরণ। আন্দোলন যে এতটা সহিংস ও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে, তা বোধকরি সরকার ভাবতে পারেনি। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদকের পুরোপুরি আস্থা ছিল তাঁদের ছাত্রসংগঠনের ওপর। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, অতীতের কোনো কোনো আন্দোলনের মতো ছাত্রলীগের ডান্ডাই এ আন্দোলনকে ঠান্ডা করার জন্য যথেষ্ট। সে মতে, অ্যাকশনও শুরু করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু হয়েছে হিতে বিপরীত।