আমরা অনেক লেখাপড়া করেও (সার্টিফিকেট গ্রহণ করেও) ডাক্তারি ডিগ্রির বহরটা ঠিকমতো ধরতে পারি না অনেকেই। কতিপয় চিকিৎসক অবিরাম এ সুযোগটিই গ্রহণ করছেন। শহর থেকে গ্রামে বা মফস্বল শহরে গিয়ে চিকিৎসাসেবা (অর্থ উপার্জন) দিতে এসব ডিগ্রি-পদবি অনেক কাজ দেয়-এ কথাটা সাধারণদের চেয়ে অনেক ডাক্তার ভালো জানেন। ডিগ্রি, সেটা যদি বিদেশি পদবাচ্যের হয়, তবে আর পায় কে! বিদেশি ডিগ্রির বহর দেখলে অনেকেই আবার বেশি আস্থায় নিয়ে নেয় ডাক্তারদের। বিদেশি ডিগ্রি ছাড়াও যদি একের অধিক ডিগ্রি-পদবি নামের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, তাহলেও রোগী পেতে সুবিধা হয়। ফলে বিদেশি না হলেও হরেক রকমের দেশি ডিগ্রি আর পদবি ব্যবহারের একটা প্রতিযোগিতা লক্ষণীয়।
আমাদের চিকিৎসকরা অবশ্যই শিক্ষিত আর সচেতন শ্রেণির মানুষ। তবে তাদের কেউ কেউ সাত থেকে দশ দিনের ট্রেনিংটাও নামের সঙ্গে জুড়ে দিতে চান-কী এক পাগলামি! এক-দু’মাসের প্রশিক্ষণ হলে তো কথাই নেই। পদবির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। কবে কোন সেমিনারে বিদেশ গেছেন, তাও ভিজিটিং কার্ডে লেগে যাচ্ছে অবলীলায়। পিজিটি ডিগ্রির মাহাত্ম্য বোঝা দায়, কিন্তু মফস্বলের অনেক চিকিৎসকের নামের সঙ্গে এটি দেখা যায়; যেমন আগে চোখে পড়ত-বিএইচএস (আপার), বাংলাদেশ মেডিকেল সার্ভিস (আপার)। কাগজপত্র সাক্ষ্য দিচ্ছে, এদেশে মেডিকেল সার্ভিসে আপার-লোয়ারের ধারণা কস্মিনকালেও ছিল না। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা বলে কিছু একটা আছে, তার গুরুত্বও কম নয়। কিন্তু পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিংটা নামের সঙ্গে একদম যায় না। বিদেশিরা এসব দেখে হাসছে কেবল। সাইনবোর্ড, প্যাড, নেমপ্লেট, ভিজিটিং কার্ড-সর্বত্রই এই মশকরা প্রতিভাত। সেদিন গ্রিন রোড দিয়ে আসতে চোখে পড়ল, একজন মেডিসিনের প্রফেসরের (তিনি আবার মেডিসিন ফ্যাকাল্টির ডিন, সেটিরও জানান দেওয়া হচ্ছে রোগী শিকারের সাইনবোর্ডে) সাইনবোর্ডের বাঁ-দিকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম। খুব জোর দিয়েই বলছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয় অনেক জ্ঞানী-গুণিজন, কিন্তু তিনি কি সরকারের মনোগ্রাম ব্যবহার করবেন? উত্তর, অবশ্যই না। তাহলে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর সরকারের মনোগ্রাম ব্যবহার করছেন কাকে বিভ্রান্ত করতে? একটা উত্তর হতে পারে-তিনি দেখেননি হয়তো, কোনো ওষুধ কোম্পানি এটি বানিয়ে দিয়েছে। কিংবা বানিয়েছে ক্লিনিকের মালিক। এটি কোনো কাজের কথা হতে পারে না। আমার ভিজিটিং কার্ড, আমার নামের সাইনবোর্ড আমি দেখব না কিংবা সেটি বানিয়ে আনার পরও আমার চোখে পড়বে না-হতেই পারে না। ডাক্তার সাহেব অন্ধ নন তো (জ্ঞানান্ধ তো হতেই পারে!)? এই হচ্ছে সমাজের উচ্চস্তরের একজন মানুষের মাত্রাজ্ঞান। তবে তার নামের পর দু-দুটো বিদেশি ডিগ্রি মেডিকেল কাউন্সিলের বিজ্ঞাপনমতে অনুমোদিত কিনা, তা বোঝা যায়নি। বস্তুত একথা জোর দিয়েই বলা যায়, মেডিকেল কাউন্সিলের বিজ্ঞাপনটি ডাক্তারদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। এ-যাবৎ কারও ভিজিটিং কার্ড, প্যাড, সাইনবোর্ড বদলে গেছে-খালি চোখে মালুম হয় না তা। বিএমডিসিকে হয়তো এজন্য বড় কোনো অ্যাকশনে যেতে হবে। নৈরাজ্য দূর করতে এর কোনো বিকল্প নেই।
সর্বত্রই এ অবস্থা। শিক্ষক নামের পর ব্যবহার করছেন ‘ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট’ অথবা ‘গোল্ড মেডেলিস্ট’। এতে বেশি বেশি ছাত্র পড়াতে সুবিধা হয়, না অর্থলাভে; বোঝা দায়। তবে এটি নামের পর, তা ভিজিটিং কার্ডই হোক বা সাইনবোর্ড, ব্যবহারের জন্য কোনো বিষয় হতে পারে না। শেষ অবধি ইউজিসি কিংবা শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে বিজ্ঞাপন জারি করতে হবে কিনা এখনো মালুম করা যাচ্ছে না। এখন মন্ত্রী মর্যাদা পেয়ে সেটির জানান দিতে হয় ভিজিটিং কার্ডে-স্বনামধন্য শিক্ষকের কাণ্ড এটি। হায়!)। সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে কোনো কোনো এনজিও কর্মী সরকারের মনোগ্রাম ব্যবহার করছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি।
পেশাজীবীরাই বা পিছিয়ে থাকবেন কোন দুঃখে? তারাও নামের পর ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ ইত্যাদি ব্যবহার করছেন। কার্ডে আরও কীসব-কে জানে ইঞ্জিনিয়ার বা কৃষিবিদ সমিতিকে আবার কবে বিজ্ঞাপন দিয়ে এসব ঠিক করে দিতে হয়! একই অবস্থা গ্রাম্য-কবরেজদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মানলাম, তারা অনেকটাই না বুঝে করেন। কিন্তু আমাদের আইজীবীদের হাতে কৌঁসুলি শব্দটার একদম বারোটা বেজে গেছে। অধিকাংশই এটিকে চন্দ্রবিন্দু ছাড়া (তাও হতে পারে) এবং স-এর বদলে শ এবং দীর্ঘ-ঈ কার দিয়ে লিখছেন। বিএমডিসি যখন বিজ্ঞাপন দিয়ে ডিগ্রি কাটছাঁট করতে চাইছে, ঠিক সেরকম সময়ে নারায়ণগঞ্জে একজনের দেখা মিলেছে, যিনি বার এট-ল করেও সেটি কোথাও লেখেন না। বছর বিশেক আগের ঘটনা। বাবার ইচ্ছায় ঢাকা ছেড়ে যাদবপুর গেছেন ইংরেজি পড়তে। ভর্তির পর পঁয়ত্রিশ-চল্লিশজন শিক্ষকের কারও নেমপ্লেটে নামের আগে ড. না দেখে মনটন খারাপ হয়ে গেল-তখন ঢাবির ইংরেজি বিভাগে ছ’-সাতজন ডক্টরেটধারী পড়াচ্ছেন। শেষ অবধি বিভাগের অফিসে খোঁজ নিতেই হলো। বিভাগের কেরানি জানালেন, ৩৭ শিক্ষকের ৩৪ জনই পিএইচডিধারী; তাই কেউ আর লিখছেন না, আর বাকিরা তখনো বেশ জুনিয়র।