ছাত্রসমাজের একটি বড় অংশ সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে। তারা একের পর এক বিশাল সমাবেশ ও মিছিল করেছে। একটি কথা স্পষ্ট করা দরকার যে, এই আন্দোলনকারীরা সর্বোতভাবে কোটা প্রথার অবসান দাবি করেনি। তাদের দাবি কোটার যৌক্তিক সংস্কার। তারা বলেছে, অনগ্রসর নৃ-গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু কোটা থাকতে পারে। তবে তা তাদের মতে ৫ শতাংশের বেশি হওয়া সংগত নয়। ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল। সেই আন্দোলনের সময়ও ছাত্ররা কোটা প্রথার সংস্কার দাবি করেছিল। আন্দোলনের ব্যাপকতা ও তীব্রতা দেখে সেই সময় প্রধানমন্ত্রী কিছুটা ‘ত্যক্তবিরক্ত’ হয়ে পুরো কোটা প্রথার অবসান ঘটান। সেদিন এর জন্য সংবিধানে কী বাধ্যবাধকতা আছে, তা বিচারবিশ্লেষণ করে দেখা হয়নি। সেই সময় সাময়িক উত্তেজনার বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে কোটা সংস্কারের জন্য যদি একটি কমিশন গঠন করা হতো এবং কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যুক্তিসংগতভাবে কোটা সংস্কার করা হতো, তাহলে কোটা বাতিলের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করার প্রয়োজন হতো না এবং বর্তমানে আন্দোলন সৃষ্টি হতো না।
হাইকোর্টের রায় আন্দোলনে ঘৃতাহুতির কাজ করেছে। তবে সংবাদপত্রে বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্টের রায় সম্পর্কে যেসব খবর বেরিয়েছে, তা থেকে খুব সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে না আসলে হাইকোর্ট কী বলতে চেয়েছেন। কোনো কোনো সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, কোটা বাড়ানো-কমানো যেতে পারে। এ থেকে পুরো বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা করা যায় না। আমার হাতে যেহেতু রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি নেই, সেহেতু আমার পক্ষে এ নিয়ে মন্তব্য করা দুষ্কর। সর্বোপরি আমি আইনবিদ নই। সুতরাং হাইকোর্টের এ রায়ের ব্যাখ্যা দেওয়ার এখতিয়ার আমার নেই। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করা হলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশনা দেন। ফলে সাময়িকভাবে হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়ন স্থগিত হয়ে যায়। আগামী ৭ আগস্ট সুপ্রিমকোর্টের বেঞ্চে বিষয়টি নিয়ে শুনানি হবে এবং এ শুনানির ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে কোটার ভবিষ্যৎ।
সুপ্রিমকোর্টের রায়ের জন্য বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ইতোমধ্যে পরিস্থিতি খুবই দ্রুততার সঙ্গে বদলে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনকারীরা চরমভাবে অপমানিত বোধ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে রোববার রাতে তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে স্লোগান দিতে থাকে, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’; ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’। আন্দোলনকারীদের নিজেদের রাজাকার দাবি করা কোনো গৌরবদীপ্ত দাবি নয়, বরং তীব্র ক্ষোভ ও অভিমানের বহিঃপ্রকাশ। তবুও বলতে হয়, এমন স্লোগান অনেকেই আক্ষরিক অর্থে নিতে পারে এবং এতে তারা বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়তে পারে। এ বিবেচনায় অভিমান করেও নিজেদের রাজাকার দাবি করা যুক্তিসংগত নয়।
এদেশে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য রাজাকার আখ্যানটি নির্বিচারে ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে জাতির মধ্যে বিভাজন ও বিরোধ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। এটা মোটেও মঙ্গলজনক নয়। স্বাধীনতার পরপর বিভিন্ন অফিস-আদালত ও প্রতিষ্ঠানে ভারত থেকে প্রত্যাগত ব্যক্তিরা যারা ভারতে যাননি তাদের বিরুদ্ধে নানাভাবে হম্বিতম্বি করতে থাকে এবং তাদের অচ্ছুতবর্গে পরিণত করার প্রয়াস পায়। এ পরিস্থিতি ছিল ভয়ানক উদ্বেগজনক। প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম এনায়েতউল্লাহ খান তার বিখ্যাত ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘হলিডে’তে একটি ডিসপাচ লেখেন। এর শিরোনাম ছিল ‘সিক্সটি ফাইভ মিলিয়ন কোলাবোরেটার্স’। সেই সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। এর মধ্যে ১ কোটি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। এদের সবাই মাঠে-ময়দানে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি। অথচ দেশের সাড়ে ৬ কোটি মানুষ অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিল। মুষ্টিমেয়সংখ্যক পাকবাহিনীর সহচর ছাড়া অন্যরা ভীষণ অনিশ্চিত জীবনযাপন করেছে। তাদের অনেকে পাক সামরিক বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। বলা যায়, অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে যারা ছিল, তারা প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে বেঁচে ছিল। তারা জানত না তাদের জীবনে কখন চরম বিভীষিকা নেমে আসবে। এ মানুষগুলো নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আহার দিয়েছেন, চিকিৎসা দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন এবং শত্রু সম্পর্কে প্রয়োজনীয় খোঁজখবর দিয়েছেন। এ অবরুদ্ধ মানুষরা সহায়তা না দিলে মুক্তিযুদ্ধ কি সফল হতো? একটি দেশের মুক্তি সংগ্রাম তখনই সফল হয়, যখন দেশের ব্যাপক মানুষ এ সংগ্রামকে নানাভাবে সহায়তা করে। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ৯৯ শতাংশ মানুষ নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিল বলেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং হানাদাররা পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। এনায়েতউল্লাহ খানের ডিসপাচটি প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতফেরতরা তাদের আস্ফালন অনেকাংশে বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যটি কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজের অনুভূতিতে আঘাত করায় ১৯৭২-এর মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমরা দেখেছি, ছাত্রসমাজের বিপুল অংশ কোটা সংস্কার আন্দোলনে শামিল হয়েছে। এরা সবাই তরুণ। এরাই আগামী দিনে দেশের গুরুদায়িত্ব পালন করবে। এরা যদি রাজাকার হয়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ কী? কোনো সমীক্ষায় বা কোনো বিচার-বিশ্লেষণে এদেরকে রাজাকার বলা যায় না। এরা মিছিল-সমাবেশে বাংলাদেশের পতাকা আন্দোলিত করে। এরা মাথায় লাল-সবুজ প্রতীক সংবলিত ফেটি ধারণ করে। এদের দেশপ্রেমকে সন্দেহ করলে গোটা দেশের মানুষের দেশপ্রেমকে সন্দেহ করা হয়।
যে কোটা ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল, তাতে ৫৬ শতাংশই ছিল কোটা। অর্থাৎ গরিষ্ঠ অংশই ছিল কোটার অধীন। কোনো যৌক্তিক ব্যবস্থায় গরিষ্ঠ অংশকে কোটাভুক্ত করা যায় না। এ কোটা ব্যবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল ৩০ শতাংশ। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর অনেক মুক্তিযোদ্ধাই বেঁচে নেই। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক আছে। একটি দৈনিক পত্রিকা থেকে দেখা যায়, ৫৫ হাজার তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হয়েছে স্বাধীনতার পর! এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা সংশোধিত হওয়ার ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমান পর্যায়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন শুরু হয়েছিল, তখন এর মধ্যে দেশের বৃহত্তর রাজনীতির কোনো ছাপ ছিল না। আন্দোলনের স্লোগান ছিল-‘মেধা না কোটা, মেধা মেধা’। আন্দোলনকারীরা একটি মেধাভিত্তিক প্রশাসন ব্যবস্থার দাবি জানাচ্ছিল। দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ শ্লথগতির হওয়ার ফলে ব্যক্তি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি চাকরি একমাত্র ভরসার স্থল হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে সরকারি চাকরিতে মেধার স্বীকৃতি চাকরিক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসান ঘটাবে বলে ছাত্রছাত্রীদের বিপুল অংশ মনে করে। তাদের এ মনে করা যুক্তিসংগতও বটে। মেধাতন্ত্রকে পরিহার করে কোনো অনুন্নত দেশ উন্নয়নের শিখরে আরোহণ করতে পারে না। সিঙ্গাপুরের নজরকাড়া উন্নয়নের পেছনে রয়েছে মেধাতন্ত্রের প্রতি নেতৃত্বের প্রবল আস্থা।