দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসার পরদিনই, অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি সাময়িক সংবিধান আদেশ বলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পদেক্ষপ নেন। যদিও এর তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তিনি দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন এবং একইসঙ্গে পুনরায় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থায় ফিরে যান।
এর ১৬ বছর পরে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়। নির্বাচনের আগে থেকেই অবশ্য বলা হচ্ছিল যে, দেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা চালু করা হবে। যে কারণে ক্ষমতাসীন বিএনপি ছাড়া অন্যান্য সব দল প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির পরিবর্তে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির জন্য জোর দাবি জানাতে থাকে।
১৯৯১ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংসদীয় সরকার প্রবর্তনবিষয়ক সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপনের নোটিশ দেয়। ৩ জুন পাঁচ দলের এক সভায় তিন জোটের রূপরেখা পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ৫ জুন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ‘সরকার পদ্ধতি ফয়সালা করে আমাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিন’ বলে আহ্বান জানান। অবশেষে ৯ জুন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভায় সংসদীয় পদ্ধতি সরকারের প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং পরদিন দলের সংসদীয় সভায় ওই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানানো হয়।
১ জুলাই জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে খালেদা জিয়া বলেন, ‘সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ অপরদিকে বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ‘জনগণের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করে বিএনপি সরকার পদ্ধতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
প্রসঙ্গত, বিএনপির দলীয় ম্যানিফেস্টোতে শুরু থেকেই প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থার কথা ছিল। সরকার গঠনের পরও তারা প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল। সেক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয় সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওই পদে তাদের প্রার্থী নিয়ে। কারণ নির্বাচনের পরপর বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। তার পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট পদে অন্য কাউকে তারা চিন্তা করতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় অন্যান্য দলের দাবিকৃত সংসদীয় পদ্ধতির সুবিধাটা তাদের উপলব্ধিতে আসে। তারা ভেবে দেখল যে, বেগম জিয়া যেহেতু প্রধানমন্ত্রী হয়েই গেছেন, ফলে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করা হলে আর কোনো নির্বাচনি ঝুঁকিতে যেতে হবে না। কেননা তিনিই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন এবং একইসঙ্গে সরকারের নির্বাহী প্রধান হয়ে যাবেন।
১৯৯১ সালের ২ জুলাই সরকার পদ্ধতি সম্পর্কিত সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিল এবং বিচারপতি সাহবুদ্দীন আহমদের উপ-রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ থেকে শুরু করে তার ক্ষমতা পরিচালনাকালীন সকল কর্মকাণ্ডের বৈধতা প্রদান এবং প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যাওয়া সম্পর্কিত বিল উত্থাপন করা হয়। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের আবদুস সামাদ আজাদ সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন সম্পর্কিত সংবিধান সংশোধনী বেসরকারি বিলটি ৪ জুলাই জাতীয় সংসদে উত্থাপন করলে স্পিকার একে সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী বিল বলে আখ্যা দিয়ে রুলিং দেন। স্পিকারের এই রুলিং নিয়ে সংসদে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় এবং বিরোধী দল ওয়াক আউট করে।
৯ জুলাই সরকারি দল উত্থাপিত সংবিধান সংশোধনী বিল এবং বিরোধী দলের বিলগুলো সর্বসম্মতিক্রমে বিশেষ কমিটিতে পাঠানো হয়। এ সময় সংসদ খুবই উত্তপ্ত থাকে। প্রতি অধিবেশনেই সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এবং তুমুল বাকবিতণ্ডা চলে।
১৭ জুলাই গণতন্ত্রী পার্টির নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে স্পিকার আবদুর রহমান বিশ্বাসের যুক্তি-পাল্টা যুক্তির একপর্যায়ে স্পিকার সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে হাউস থেকে বের করে দেয়ার নির্দেশ দিলে ঘটনাটি সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
২৮ জুলাই সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বাছাই কমিটি সংসদে তাদের রিপোর্ট দেয়। রিপোর্টে প্রস্তাবিত ১১ ও ১২তম সংশোধনীর ২৬টি স্থানে পরিবর্তন আনা হয়। ৩০ জুলাই সংবিধান সংশোধনী দুটির ওপর আলোচনা শুরু হলে বিরোধী দল বিলের আরও কিছু গ্রহণ-বর্জনের দাবি করে। ওই দিনই বাকশাল আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একীভূত হয়। ৩১ জুলাই জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা সংসদে অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের পূর্বপদে ফিরে যাওয়ার বিধান সংবলিত সংবিধানের ১১তম সংশোধনীর তীব্র বিরোধিতা করেন।
ইতোমধ্যে সংবিধান সংশোধনীতে আওয়ামী লীগ সহযোগিতা করবে না বলে বিএনপি অভিযোগ করলে একে ভিত্তিহীন দাবি করে শেখ হাসিনা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। এ সময় সরকার সংবিধান সংশোধনীতে জাতীয় পার্টির সর্মথন আদায়ের লক্ষ্যে সকল নিয়ম নীতি ভঙ্গ করে কারাগারে এরশাদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির নেতাদের এক বৈঠকের আয়োজন করে। ৫ অগাস্ট রাতে এরশাদের সঙ্গে তার সেলে বৈঠক করেন সদ্য কারামুক্ত মিজানুর রহমান চৌধুরী, মওদুদ আহমদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়া। ওই বৈঠকে যোগদানের জন্য প্রয়োজন হতে পারে অনুমান করে পিজির (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) প্রিজন সেলে আটক কাজী জাফর আহমেদ ও সরদার আমজাদকে তৈরি হয়ে থাকতে বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের আর আনা হয়নি।