গত ২৯ জুন দৈনিক যুগান্তর বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রেরণ এবং বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণের তুলনামূলক চিত্র নিয়ে একটি চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘রেমিট্যান্সের চেয়ে বিদেশিদের বেতনভাতা তিনগুণ’। গত কিছুদিন ধরে ডলার সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে একটি আলোচনা জোরদার হয়ে উঠেছে। এটি হলো বাংলাদেশের কর্মজীবীরা বিদেশে কাজ করে তাদের আয় থেকে কী পরিমাণ ডলার দেশে রেমিট্যান্স হিসাবে পাঠায়। এর পাশাপাশি আলোচনায় উঠে আসে বিদেশি কর্মী ও কর্মকর্তারা বাংলাদেশে কাজ করে কী পরিমাণ ডলার তাদের নিজ নিজ দেশে রেমিট্যান্স হিসাবে পাঠায়। এ দুয়ের হিসাব দিয়েই নির্ধারিত হয় রেমিট্যান্স বাবদ নিট কত ডলার বাংলাদেশ আয় করতে পারছে। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কথায় কথায় বলি, আমাদের দেশের মেহনতি মানুষ ও অন্যান্য কর্মী বিদেশে কাজ করে যে রেমিট্যান্স দেশে পাঠায়, তা আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বিশাল ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এতে খুব উৎফুল্ল হওয়ার সুযোগ নেই। দেখতে হবে অন্যান্য দেশের কর্মী ও কর্মকর্তারা বাংলাদেশে এসে চাকরি করার সুবাদে কী পরিমাণ ডলার নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশ থেকে পাঠায়। বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কর্মীদের মধ্যে ভারতীয় কর্মীর সংখ্যাই সর্বাধিক।
২০১৫ সালের সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্যমতে, বাংলাদেশ ছিল ভারতের প্রবাসী আয়ের তৃতীয় উৎস। টিআইবির তথ্যমতে, প্রতিবছর ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি অবৈধভাবে দেশের বাইরে পাঠাচ্ছেন বিদেশিরা। বাংলাদেশে এনজিও, আইটি এবং গার্মেন্টসহ প্রায় ৩২টি ক্ষেত্রে চাকরি করছেন বিদেশিরা। পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের দেশে ভারত ও শ্রীলংকানদের চাহিদা প্রচুর। বিভিন্ন কারণে এ চাহিদা তৈরি হয়েছে। সেটা হতে পারে পেশাগত কর্মক্ষমতা ও অভিজ্ঞতার কারণে। তারা আমাদের দেশীয় কর্মকর্তাদের তুলনায় বেশি বেতনভাতা পায় তাদের কর্মক্ষমতা ও অভিজ্ঞতার কারণেই। টিআইবির তথ্যমতে, বিভিন্ন এনজিওতে কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন।
অন্য একটি গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৫ লাখ বিদেশি কর্মরত রয়েছেন। এ পরিমাণ জনশক্তি প্রতিবছর ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন তাদের নিজ দেশে, যা থেকে খুব অল্প পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছে সরকার। অথচ এসব বিদেশির আয়ের ৩০ শতাংশ কর নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কেননা বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি নাগরিকরা তাদের প্রকৃত বেতনভাতা গোপন করছেন। এ ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করছেন এদেশের নিয়োগকারী সংস্থা। এ কারণে এনজিওতে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের সত্যিকারের বেতনের চিত্র উঠে আসে না। ফলে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
যুগান্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রবাসীদের দেশে পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহের তিনগুণের বেশি অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় বাংলাদেশ থেকে বেতনভাতা বাবদ নিয়ে গেছেন বিদেশি কর্মীরা। ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে সোয়া ১১ গুণ। একই সময়ে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা নিজ দেশে বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়ার হার বেড়েছে ৩৭ গুণ। অর্থাৎ বাংলাদেশে বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স Inflow যে হারে বেড়েছে, তার তুলনায় বহুগুণ হারে বেড়েছে বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স outflow ।এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ছে। শুধু ২০২৩ সালেই বিদেশি কর্মীরা বাংলাদেশ থেকে বেতনভাতা বাবদ বৈদেশিক মুদ্রায় নিয়েছেন ১৫ কোটি ডলার, ওই সময়ে ডলারের দাম অনুযায়ী ১৬৫০ কোটি টাকা। বৈধভাবে নেওয়ার চেয়ে আরও বেশি অর্থ নেওয়া হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। এর মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারের নজিরও রয়েছে। অতি সাম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানো ও রেমিট্যান্স আসার চিত্র তুলে ধরা হয়।
সরকারের সুরক্ষা সেবা বিভাগ ও পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশে অবস্থানরত বৈধ বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ১৬৭। এর মধ্যে ভারতীয় নাগরিকরাই বেশি, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চীনের নাগরিক। ভারতীয় ৩৭ হাজার ৪৬৪ এবং চীনের ১১ হাজার ৪০৪ জন। বাকিরা অন্যান্য দেশের। তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মী হিসাবে নিয়োজিত। এর বাইরে অবৈধভাবে আরও অনেক বিদেশি আছেন, যাদের হিসাব এর মধ্যে নেই।
নির্ভরযোগ্য অনুমান হলো, বাংলাদেশে ৫ লাখ বিদেশি নাগরিক কর্মরত আছেন। অর্থাৎ বৈধভাবে থাকা বিদেশি নাগরিকদের তুলনায় বৈধ ও অবৈধ হিসাবে থাকা বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ।